বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১

আকাশের নীলেই সাগর নীল

অধ্যাপক ডাঃ ডালিয়া সৈয়দা

সময়ের নিয়মেই কেটে যাচ্ছিল জীবন; ছেদ পড়লো কুড়ি বছর পর কুর্মিটোলা সদর হাসপাতালে; কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডে; চারিদিকে তখন কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন আর সোশ্যাল ডিস্টেন্স; এক রাশ বিষন্নতা,শঙ্কা আর অস্হিরতা নিয়ে শুরু হয়েছিল সকাল আকাশের; কেমন যেন একটা গুমোট আর অনিশ্চয়তায় ঘেরা চারদিক; চেনা চারপাশ ও বড় অচেনা আজ; বদলে গেছে মানুষের চিরচেনা অভ্যেস গুলোও।

চিনের উহান প্রদেশ থেকে ছডিয়ে পড়া নভেল করোনা ভাইরাসে পুরা বিশ্ব আজ অশান্ত; শুধু একটা ফ্লাইট ডিসটেন্সে করোনা ছড়িয়ে পড়ছিল সুপার সনিক জেট বিমানের গতিতে পুরো পৃথিবীতে; এ যেন বায়োউইপনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ;  প্রবল শক্তিধর ইটালি, নিউইয়র্ক, ফ্রান্স যেন এক একটি মৃত্যুপুরি;নিউইয়র্ক আর ইটালির মত উন্নত বিশ্বে যেখানে প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় কয়েক হাজার লাশের স্তুপ; হিমবাহ গাড়িতে জড়ো করে ঠেসে রাখা শুধুই কোভিড আক্রান্ত ডেড বডি; এ মহামারিতে মৃত্যুশংকা জেনেও ঢাল হয়ে দাডিয়েছিল সমস্ত বিশ্বের ডাক্তারেরা; প্যান্ডেমিকে প্রতিদিনই বাড়ছিল  আক্রান্ত আর মৃত্যুর মিছিল; তার সংক্রমনের রেশ ছডিয়ে পড়েছিল  বাংলাদেশেও; লক ডাউনে সবাই গৃহবন্দি; অদেখা শত্রুর বিরুদ্ধে নিজের জীবন বাজী রেখে, সীমিত প্রোটেকশনে লড়ে যাচ্ছিলো আমাদের দেশের ডাক্তাররাও; এ যেন মৃত্যু শঙ্কা  জেনেও অনুপোযোগি সমরাস্ত্রে সম্মুখ সমরে ঝাপিয়ে পড়া,  অদেখা শত্রু  কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের ডাক্তারদের আত্নহুতি দেয়া ; ঠিক তখনি ঘটলো  অঘটন; ভাবে নি কখনো  এভাবে আবার দেখা হবে এ অবেলায় এই আইসোলেশন ওয়ার্ডে; জীবনের এতগুলো বছর পরে; একমুঠো রজনীগন্ধা আর নীল খাম হাতে দিয়ে দ্রুতলয়ে চলে গিয়েছিল সেদিন সাগর; ঝাপসা চোখে আকাশ তাকিয়ে ছিল সাগরের চলে যাওয়া পথের দিকে। তারপর চলে গেছে কুড়ি কুড়ি বছর; মন থেকে যে মুছে গিয়েছিল তা নয়, কখনো খুব একলা হলে, নির্জন দুপুরে  বা পড়ন্ত বিকেলে খুব বুকে বাজতো, সাগরের এভাবে হারিয়ে যাওয়া; তখনো বাতাসে ভেসে আসতো, চালতা ফুলের মিষ্টি সৌরভ বা খুব চুপিসারে এসে যেত কদম ফোটার প্রথম দিন।
 
লাশকাটা ঘরে, ডাক্তারি বিদ্যার বিশাল বই আর ওয়ার্ডে রুগীদের মাঝে, কখন যে জীবন গড়িয়ে এতদূর চলে এসেছিল, ভাববার অবকাশই ছিল না  আকাশের; ডাক্তার হয়ে মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিবে  বলেই, ডাক্তারির মত এত কঠিন আর চ্যালেন্জিং পেশাকে বেছে নিয়েছিল; সে যেন জীবনের আরেক যুদ্ধ; উদয়-অস্ত বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা; মনে আছে প্রফেশনাল পরীক্ষা প্রস্তুতির দিনগুলোতেও , চার ঘন্টাও ঘুমাতে পারতো না; সব আনন্দ আর আবেগ এক পাশে ঠেলে দিয়ে, রাত দিন একাকার করে প্রস্তুতি নিয়েছিল একেকটা প্রফ পাশের ; তারও ইচ্ছে করতো খোলা হাওয়ায় ঘন্টা চুক্তিতে, রিক্সার হুড ফেলে দিয়ে ভাবনাহীন, গাংগিনার পাড় বা সাহেব পার্ক ঘুরে বেড়াতে ; এগ্রি বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে বান্ধবী দের নিয়ে, অলস দুপুর কাটাতে; সে সব দিনগুলোতে বুকের কোথায় যেন, বিনা অর্কেষ্ট্রায়  খুব করুন সুরে সিম্ফনি বাজতো আর সাগরকে খুব মনে পডতো; দীঘির জলের মত সাগরের টলটলে চোখে নিজেকে হারিয়ে, খুঁজতে ভাললাগতো আকাশের ও; বুকের  খুব গভীরে  নিশ্বাস টা  ভারী হয়ে থাকতো, সাগর কে ছুতে না পারার কষ্টে; আকাশের বুকে সৃষ্ট, সাগরের কষ্টগুলো বাষ্প হয়ে জমতো মেঘে, ছুটতো অশান্ত দুর্বার গতিতে , অস্হির উন্মাদনায়, কখনো  জল-জোয়ারে, কখনো বা ঝড়ো বাতাসে অনাসৃষ্টির ঘনঘটায়; এক সময় শান্ত হয়ে বৃষ্টি রুপে ঝড়ে পড়তো,  শীতল ধরনী তলায়, আকাশ আর সাগরের ভার্চুয়াল, মিতালি সুখ-ছোয়ার  নগ্ন সাক্ষী বৃষ্টি হয়ে; যা ছিল, ”আকাশ আর সাগরের তপ্ত রিদয়ের অতৃপ্ত ছোয়ার বাই  প্রোডাক্ট ” ;তারপরেও আকাশের নিলেই সাগর নিল; কখনো দূর থেকে  ব্রক্ষপুত্রের বাতাসে ভেসে আসতো  চির চেনা সাগরের গন্ধ।

বুকের ভিতর ঠিক মাঝখানটায় যেখানে প্রিকর্ডিয়াম, সেখানে রিদয়ের আবরনটাই পেরিকার্ডিয়াম, যা খুব  ফাঁকা মনে হত; ওটার ভিতর হার্টটা ছিল না;  কোথায় যেন  হারিয়ে গিয়েছিল, পুরো শরীর জুড়ে শুধুই ডিঅক্সিজেনেটেড ব্লাড ছেয়ে যেত, অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধে  নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হত,অস্থির ছটফট লাগতো প্রথম দিকে; তারপর প্রকৃতির নিয়মে সব সহ্য হয়ে উঠেছে;  এত বছর পর আবার সে দম বন্ধ ভাবটা যেন টের পাচ্ছে আকাশ;  মানুষ কি সত্যি তার প্রথম প্রেম ভুলতে পারে না?? তবে কি তাই সত্যি? স্মৃতি রোমন্থন আর বিস্মৃতি মুক্তি;  প্রথম প্রেমের কোন বিস্মৃতি নেই, কোন মুক্তি নেই; সে তার আপন আলোতেই জ্বলতে থাকে; কিছুক্ষনের জন্য আকাশ হারিয়ে ফেলেছিল, নিজেকে বুঝতে শেখা সেই প্রথম বসন্তের দিনগুলোয়; যা গহীনে আজো তুমুল ঝড় তুলে যায়; অন্ধ রাতে কামিনি ফুলের গন্ধ মাদকতায়; সমাজের হিসেব কষতে গিয়ে,  যাকে নেয়া হয়  নি সেদিন  আপনালোয়; ইন্টার শেষে সাগর চলে যায় ইউএস কম্পিউটার পড়তে আর আকাশ চিকিৎসা বিদ্যায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে; মোবাইল আর ওয়াই ফাই হীন পৃথিবীতে চুপ হয়ে যাওয়া অনেক প্রেমের মত, ওদের প্রেম ও নীরবেই ঝরে গিয়েছিল কালের আবর্তে ; বুকের খুব কোনে, সুক্ষ চিনচিন এক ব্যাথার ছাপ ফেলে রেখে; তারপর ব্রক্ষপুত্রের বুক চিরে বয়ে গেছে অনেক জল। 

এম বি বি এস এর পর কয়েকজন ডাক্তার বান্ধবী মিলে, ফ্ল্যাট নিয়েছিল শাহবাগে আজিজ কো অপারেটিভ বিল্ডিংয়ে; ডাক্তারদের পড়া যেন পিছুই ছাড়ে না; নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে ছুটেছে বি এস এম এম ইউ এর বটতলায়, তারপর লাইব্রেরির লিফটের দীর্ঘ লাইনের অপেক্ষায়;একই সাথে অনারিরি, পোস্ট -গ্রাজুয়েশন আর বি সি এস এর জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলার সে কি সংগ্রাম; মনে আছে পাশ করে ও তখন ইন্টার্ন; ওর উপার্জনে  মাকে  জামদানি আর বাবাকে ঘড়ি দিয়েছিল আকাশ; হিয়া বলেছিল, বেতন ছাডা দু বছর অনারিরি করতে হবে; ডাক্তার হয়ে, বাবা মার কাছে হাত পাততে কষ্ট হবে;টাকা জমিয়ে রাখতে, পোস্ট গ্রাজুয়েশনের বই কেনা আর ফর্ম ফিলাপের জন্য; আর তাছাড়া হাত খরচের ব্যাপারটা ও তো আছেই, কতদিন পিজির লাইব্রেরি তে একটা সিংগারা খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে; ভাল কোন ড্রেস কিনে নি, মন খারাপ হলে মেঘলা আকাশ দেখে নি; বান্ধবিদের বিয়ে বা বাচ্চার আকিকা-জন্মদিনে যায় নি; ভাল গিফট না দিতে পারার লজ্জায়; ননমেডিকেল বান্ধবিরা ভেবেছে ডাক্তার হয়ে নাক উঁচু হয়ে গেছে, ভুল বুঝেছে; ব্যাবসায়ী মনোভাবের কতৃপক্ষের অবহেলায় ক্লিনিকে রুগি মারা গেলে,সব ক্ষোভ  মারমুখি হয়ে, এসে পরে কয়েক হাজার টাকায় চাকরি করা ডিউটি ডক্টরের উপর; টানা চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি আর নাইট করে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের প্রিপারেশন নেয়া বড্ড কষ্ট; মাথা ভার হয়ে থাকে; অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় বলেই কি এদেশে ডাক্তারদের ইমিউনিটি কমে গিয়ে গড় আয়ু কমে যায় !!

মাঝে মাঝে মনে হতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া, তার বান্ধবীরা নিজেদের সুখটাই বড় করে বেছে নিয়েছে; সংগীর আলোকলতা হয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে; তারা কি জনগনের ট্যাক্সের টাকায় পড়ে নি? নিজেকে বড় বেশী দুর্ভাগা দেশের নাগরিক মনে হত; কবে তারা বুঝবে একজন সদ্য পাশকরা তরুণ ডাক্তারের, নিজেকে গড়ার দীর্ঘ দেড় যুগের কঠিন পিচ্ছিল আর বন্ধুর পথের আর্তনাদ; আচ্ছা, এদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কি শুধু ডাক্তাররাই পড়ে? ইন্জিনিয়ার রা পড়ে না? বাংলা,  ইংরেজি, ইতিহাস, আইনের ছাত্ররা পড়ে না?? কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম। ইউজিসির মাথাপিছু খরচের হিসাবই তার স্পষ্ট প্রমান। স্বাস্হ্যখাতে রাজস্ব আয়ের মাত্র  ১% খরচ হয়;তারপরেও তাদের উপরই সাধারন মানুষের যত ক্ষোভ; ছড়ি ঘোরাবার সময় মনে হয় এরা দেশের মানুষের টাকা চুষেচুষে খেয়েছে, এদের শায়েস্তা করতে হবে। সামান্য সর্দি কাশি হলে তাঁরাই  ট্রীটমেন্ট্রের নামে বিদেশ উড়াল দিয়েছে; একই সাথে রথ দেখে কলাও বেঁচে এসেছে ; ক্লাসে ভালো ছাত্র বিধায় আজ যারা ডাক্তার; জীবনের কোন যোগ্যতার প্রমানে তারা কখনো পিছিয়ে ছিল? তারা এটা অর্জন করেছে; কেউ দয়া পরবশ হয়ে তাদের কিছু দিয়ে দেয় নি। এই দুর্যোগের সময় ডাক্তার দের উপর ক্ষোভ যেন আরো একটু বেশী; কেউই চাকরি হারালো না, হারালো ছয়জন চিকিৎসক! কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ডাক্তার রা খাবার পাচ্ছে না দিনের পর দিন; করোনা আক্রান্তের ভয়ে বাবুর্চি পালিয়েছে; কোথাও বাড়ীঅলা ডাক্তার ভাড়াটিয়াকে বিতাড়িত করে দিয়েছে; আর আজ, কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে দেশ হারিয়ে ফেলেছে ৫  জন বিষেশজ্ঞ  চিকিৎসক, নকল মাস্ক আর নিম্ন মানের পিপিই পরে, কোভিড চিকিৎসা করে মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে, নিজের জীবন বিপন্ন করে (এফ সি পি এস মেডিসিন, এম ডি কার্ডিওলজি, বি সি এস) ডাক্তার মঈনুদ্দিন, একটা এয়ার এম্বুলেন্সের অভাবে মরে যায়, জাতীয় সম্পদ হয়েও সে সেটার নাকি এনটাইটেল নয়;অথচ  এসি ল্যান্ড রা যখন তখন এটা পায়; জীবনের কোন স্তরে মঈনুদ্দীন রা এসি ল্যান্ড দের চেয়ে পিছিয়ে পড়া স্টুডেন্ট ছিল? এই ডাক্তার তার শিক্ষাজীবনের কোন স্তরে কারো চেয়ে কম মেধাবী ছিল? শর্টকাটে জীবন গড়তে চেয়েছিল? তাদের কত পার্সেন্ট এই ডাক্তারের চেয়ে বেশি মেধার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিল? ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে কেন এই আকাশ পাতাল বৈষম্য?  একেকটা মঈন তৈরি হতে ১৮ থেকে ২০ বছরের রাতের ঘুম বিসর্জন দিতে হয়, জীবনের ভোগ আনন্দ জলান্জলি দিতে হয়; জীবনের মাঝ বয়সে এসেও বিকেল সন্ধ্যা রাত ছুটতে হয় শুধু রোগী দেখবে বলে, কখনো কি একটু বসেছে এসি রুমে আরাম কেদারায়?  রাত জেগে  আর এংজাইটিতে ভুগে তাদের গড় আয়ুই কমে যাচ্ছে।
 
এ সমস্ত উত্তরহীন গভীর ভাবনা গুলোয় ডুবেছিল কুর্মিটোলায় সেদিন আকাশ;  জীবন বিপন্নের ঝুঁকি নিয়েই সেবা দিয়ে যাচ্ছিল করোনা আক্রান্ত রুগীদের, নিম্ন মানের পিপিই আর নকল এন ৯৫  মাস্কের ছদ্ম প্রোটেকশনে; হঠাৎ আলোর ঝলকানি; ঠিক দেখছে তো আকাশ? সামনে তার সাগর!!! কৈশোরের হারিয়ে ফেলা প্রথম প্রেম; যাকে হারিয়ে খুঁজেছে বহু বছর; ভুলে নি আজো; মায়ের অসুস্হের কথা শুনে দেশে এসেছিল, এসেই লক ডাউনে আটকে গেছে; নিউ ইয়র্কে কোভিডের মৃত্যুপুরি থেকে সংক্রমিত হয়েই হয়তো এসেছিল, বুঝতে পারে নি; এসে চৌদ্দ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতেই শুকনো কাশ, বুক ব্যাথায় নিশ্বাস নিতে পারছিল না; করোনা পজিটিভ হয়ে আসলো কুর্মিটোলা সদর হাসপাতালে, কোভিড ১৯ রুগীদের চিকিৎসার হাসপাতালে; আকাশের বুক ধপাস করে উঠলো; স্মৃতির রুপাল পাখি যেন উড়ে এল এই ভোর সকালেই কোভিড হাসপাতালে, আকাশ কে উডিয়ে নিয়ে গেল নিমিষে সাত সাগর আর তোর নদীর পাড়ে,  পাশাপাশি বেড়ে ওঠা সেই সোনালী কৈশোরে। যেখানে শৈশব-কৈশোর কেটেছে অস্হির এক অস্ফুট উন্মাদনায় বাড়ির কার্নিশে, ঝুল বারান্দাতে, বা পাঁচ ইন্চি সিমানা প্রাচীরে ভারসাম্য রক্ষা খেলাতে; ছাদ-বারান্দা-সিড়ি বা পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে সাগর পানে চেয়ে থাকতো আকাশ, এ যেন এক অন্তহীন চেয়ে থাকা;  এভাবে দূর থেকে দেখে আকাশের মন ভরতো না, মন চাইতো আরো কাছ থেকে ওকে দেখে, সারাক্ষণ দেখে, এ যেন এক নেশা, লোহা আর চুম্বকের ক্রমাগত প্রবল থেকে প্রবলতর আকর্ষনে সৃষ্ট, দূর্নিবার টানের নেশা; আরো কাছে আসার নেশা, এক বিন্দুতে না আসা পর্যন্ত যে নেশার টান চলতেই থাকে। আকাশের  মন খারাপে সাগর বিষন্ন কেঁদেছে ; সাগরের বিষন্নতায় আকাশ নীরবে ঝরেছে; সামাজিক বৈষম্যে  কখনো পারে নি ভালবাসি চিরকুট লিখে, কেউ কারো  হাতে গুঁজে দিতে; নীরব ভালবাসা নীরবেই গুমরে মরেছে।

নিজের সমস্ত ডাক্তারি বিদ্যা আর ভালবাসায় সাগরকে সুস্থ  করে  তোলে আকাশ নিজেই আজ ভেন্টিলেটরে;  অক্সিজেন স্যাচুরেশন ক্রমাগত কমে গিয়ে  ভারসাম্যহীন আজ আকাশ; ঠিক যেমন মানুষের নিষ্ঠুরতায় সবুজ কে হারিয়ে কোভিড আক্রমণে ভারসাম্যহীন প্রকৃতি আজ; নিজের জীবন বাজী রেখে আকাশ একজন বাংলাদেশীকে বাচালো; একজন ইউ এস সিটিজেন কে বাঁচালো;  তার প্রথম প্রেম কে বাঁচালো; নিজেই চলে যাওয়ার পথের পথিক হল; জীবন হয়তো আবার প্রানচঞ্চল হয়ে উঠবে, লক ডাউনে তো আর জীবন বেধে রাখা যায় না; আবার সাবওয়ের হুইসেল বাজবে, আবার প্লেন চলবে, সাগর রা আবার আকাশে চড়ে নিজের ঘরে ফিরবে; আকাশের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে শ্বাস ক্ষীন হয়ে আসছে, ক্রমাগত অক্সিজেন সেচুরেশন কমছে অনেক নীচে; নিজেকে আবার দেখতে পাচ্ছে পাঁচ ইঞ্চি সীমানা প্রাচীরের ভারসাম্য খেলায়; প্রাচীরের ওপারেই দাডিয়ে সাগর; গভীর নীল আজ সাগর; আকাশের ক্ষীন হয়ে আসা প্রদীপের আলোয় সাগর কে ঝাপসা দেখাচ্ছে খুব অস্পষ্ট; ভালবাসাকে বাচিয়ে আকাশ আজ আকাশেই ভেসে বেড়াচ্ছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে সপ্তর্ষী মন্ডলে. প্রকৃতি কি মনে রাখবে আকাশের কথা !

আকাশ আজ হারিয়েছ
পলকহীন মেঘের মত;
সাগর বুকে জমা রেখে
স্বপ্ন গুলো যত।।

লেখিকা:  এনাটমিস্ট; পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট; জেরন্টোলোজিস্ট, টরন্টো, কানাডা।