বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণ পাচ্ছেন না ছোট উদ্যোক্তারা

নিজস্ব সংবাদদাতা : করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া সংকটে টিকে থাকতে সরকার গ্রাহকের ঋণের সুদে ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তাতে বড় শিল্প ঋণ নিতে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা ঋণও পাচ্ছে বেশ। তবে ছোট ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। ছোট উদ্যোক্তাদের অনেকে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ পাচ্ছে না। আবার একটি অংশ প্রণোদনার ঋণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না। কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে গেছে। এসব কারণে ছোট আকারের ঋণ বিতরণ হচ্ছে খুব কম।

কুটির, অত্যন্ত ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প (সিএমএসএমই) খাতের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। কৃষক ও নিম্নআয়ের পেশাজীবীদের তহবিল থেকে বিতরণেও তেমন অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে চাহিদা বেশি থাকায় বড় শিল্পের জন্য ঘোষিত তহবিলের আকার এরই মধ্যে দু’দফা ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে বিরূপ পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ না হয়, সে লক্ষ্যে গত এপ্রিলে এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে বিভিন্ন খাতে ঋণ হিসেবে ৯২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বিতরণের ঘোষণা আসে। গত আগস্টের মধ্যে পুরো ঋণ বিতরণ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকরা এখান থেকে ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। ৯ শতাংশ সুদ ধরে বাকি অর্থ সরকার ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি দেবে। আর ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের পর বড় অংশই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন পাবে। ঋণ বিতরণ পরিস্থিতি আশানুরূপ না হওয়ায় তিন দফায় সময় বাড়িয়ে সিএমএসএমই খাতের জন্য ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, বড়রা যে করেই হোক টিকে থাকার চেষ্টায় কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ঋণ নেওয়ার আগে পরিশোধ বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকে। বড় গ্রাহকদের অনেকের মধ্যে সে তুলনায় উদ্বেগ কম। আর বাংলাদেশে এ যাবৎ বিশেষ ছাড়ে ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলের সুবিধার বেশিরভাগই বড় গ্রাহকরা পেয়েছেন। অন্যদিকে, বরাবরের মতো ব্যাংকারদের মধ্যেও ক্ষুদ্র গ্রাহকদের ঋণ দিতে অনীহা রয়েছে। এসএমই উদ্যোক্তাদের অনেকে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ পাননি এমন অভিযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকারদের অনেকে অবশ্য বলছেন, উপযুক্ত গ্রাহক না পাওয়ায় তারা ঋণ দিতে পারছেন না। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএফসির সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ এসএমই উদ্যোক্তা প্রণোদনার তহবিল বিষয়ে জানেন না। এ অবস্থায় গ্রাহকদের সচেতন করতে সিএমএসএমই তহবিল বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বছর বর্ষসেরা জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার পাওয়া পিপলস ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজবিন হাফিজ বলেন, প্রণোদনার ঋণের জন্য সাভার ও আশুলিয়ার দুটি ব্যাংক শাখায় গিয়ে তিনি ঋণ পাননি। দুটি শাখা থেকেই তাকে জানানো হয়েছে, সিএমএসএমই খাতের জন্য নির্ধারিত প্রণোদনার ঋণ আপাতত তারা দিচ্ছেন না। তবে চাইলে তিনি জামানত দিয়ে নিয়মিত সুদে ঋণ নিতে পারবেন। এ কারণে তিনি ঋণ নেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, প্রণোদনার আওতায় ঋণ বিতরণের জন্য নিয়মকানুন শিথিল করা হয়েছে। বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে নানা ছাড় দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ৫৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। এর পরও কোনো ব্যাংক যেন তারল্য সংকটে না পড়ে সে জন্য আমানতের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ বা সিআরআরের হার দেড় শতাংশ কমানো হয়েছে। অবশ্য প্রণোদনার টাকা আদায় হোক বা না হোক, ব্যাংকগুলোকে তা যথাসময়ে ফেরত দিতে হবে। কোনো ব্যাংক ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত হিসাব থেকে কেটে সমন্বয় করা হবে। এসব কারণে অনেক ব্যাংক এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণে হয়তো অনীহা দেখাচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, বড় ঋণের তুলনায় ছোট ঋণের চাহিদা কম। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, অনেকে এই প্রণোদনার ঋণ বিষয়ে জানেন না কিংবা ব্যাংকের সঙ্গে তাদের আগে থেকে যোগাযোগ না থাকায় ব্যাংকও হয়তো সেভাবে সহযোগিতা করছে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে জামানত দেওয়ার মতো অবস্থা না থাকায় ঋণ নিতে আসেন না। এসব কারণে ছোট উদ্যোক্তারা কম ঋণ পাচ্ছেন।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ এনজিও থেকে ঋণ নেয়। যে কারণে ব্যাংকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ওই পর্যায়ে থাকে না। তবে বড় শিল্পের মালিকদের রপ্তানিসহ নানা কারণে প্রতিনিয়ত ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। যে কারণে বড় উদ্যোক্তারা প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে যত দ্রুত ঋণ পেয়েছেন, ছোটরা সেভাবে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষুদ্র কারখানা গ্রামে। আর গ্রামীণ শাখার বেশিরভাগই সরকারি ব্যাংকের। অথচ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে বেশি পিছিয়ে আছে। ব্যাংক ঋণ দিতে না চাইলে প্রয়োজনে পিকেএসএফের মতো ক্ষুদ্রঋণ দানকারী সংস্থার মাধ্যমে বিতরণের উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শিল্প ও সেবা খাতের ৩৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে গত ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৫১১টি প্রতিষ্ঠানের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ২১৭ কোটি টাকা, যা ওই তহবিলের ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে চলতি মূলধন হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে ২২ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। আর রপ্তানিমুখী শিল্পের জুনের বেতন বাবদ আড়াই হাজার কোটি এবং জুলাইয়ের বেতন হিসেবে ২ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এর বাইরে এপ্রিল ও মে মাসের বেতন-ভাতা বাবদ দেওয়া হয় ৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। সিএমএসএমই খাতের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ৬ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। মোট সিএমএসএমই ঋণের যা ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। দেশের ৪০ হাজার ৯২৫টি প্রতিষ্ঠানের মাঝে এ পরিমাণ অর্থ দিয়েছে ব্যাংকগুলো।

শিল্প খাতের বাইরে নিম্নআয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এনজিওর মাধ্যমে বিতরণের লক্ষ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার আওতায় একটি তহবিল রয়েছে। গত ২১ অক্টোবর পর্যন্ত এ তহবিল থেকে ৭২টি এনজিও ৯ শতাংশ সুদে ৯০ হাজার ৪১ জনের মাঝে এক হাজার ৩৩৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। পোলট্র্রি, মৎস্য, ডেইরি, প্রাণিসম্পদ, মৌসুমভিত্তিক ফুল ও ফল চাষের জন্য গঠিত ৫ হাজার কোটি টাকার স্কিম থেকে ৮৪ হাজার ৯৪১ জনকে দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার ৩৫০ কোটি ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ডলার করা হয়েছে। ইডিএফের ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা সমপরিমাণের নতুন এ তহবিল থেকে গত ২১ অক্টোবর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ১০ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। তবে প্রাক-জাহাজীকরণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে মাত্র ৪৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। এসবের বাইরে শস্য ও ফসল চাষে কৃষক পর্যায়ে গত এপ্রিল থেকে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সুদহার ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাকি ৫ শতাংশ ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আইএফসির পক্ষ থেকে মোট ৫০০ প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, এসএমই খাতের ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান নগদ টাকার সংকটে রয়েছে। করোনার প্রভাবে এসএমই খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান অস্থায়ীভাবে বন্ধ আছে বা আংশিক খোলা থাকছে। এসব কারণে ৩৭ শতাংশ শ্রমিক স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে কাজ হারিয়েছেন। যারা চাকরিতে আছেন তাদের মধ্যেও ৭০ শতাংশ অরক্ষিত অবস্থায় আছেন। এ খাতের ৯৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ব্যাপকভাবে কমেছে। সামগ্রিকভাবে ৮০ শতাংশের বেশি ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী আগামী ৬ মাস বিক্রি ও চাকরির ওপর নেতিবাচক প্রভাব থাকবে বলে মনে করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ছোট উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ বিতরণের জন্য নানাভাবে চাপ তৈরি করা হচ্ছে। পিছিয়ে থাকা ব্যাংকগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, বৈঠকসহ নানাভাবে বলা হচ্ছে। এর পরও যথাসময়ে ঋণ বিতরণ শেষ না হওয়ায় তিন দফা সময় বাড়িয়ে এখন নভেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার জন্য শিগগিরই ব্যাংকগুলোকে আরও কঠোর বার্তা দেওয়া হবে।