বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কাউন্সিলর চামেলীর দখলে শত কোটি টাকার জমি, অসহায় রেল কর্তৃপক্ষ

নিজস্ব সংবাদদাতা : রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ফুলবাড়িয়ায় আনন্দবাজারের বাংলাদেশ রেলওয়ের শত কোটি টাকার জমি দখল করে রাখার অভিযোগ উঠেছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলীর বিরুদ্ধে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত আসন-৫ (১৩, ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ড)-এর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তিনি। অভিযোগ রয়েছে, চামেলীর নেতৃত্বে প্রতারক চক্র ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ২.৮৭ একর জমি দখল করে রেখেছেন। রেল কর্তৃপক্ষ একাধিকবার মূল্যবান এই সম্পত্তি উদ্ধার করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, রেলভবনের একটি অসাধু চক্র বিপুল অর্থের বিনিময়ে চামেলীর নেতৃত্বে দখলদারদের পক্ষ নেওয়ায় উদ্ধার অভিযান ব্যর্থ হয়। এমনকি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও একাধিক নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সম্প্রতি সরকারের এই সম্পত্তির দখল ফিরিয়ে আনতে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাও অনুসন্ধান শুরু করেছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এই সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছি। কিন্তু দখলদাররা আদালতে একটার পর একটা মামলা করে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম স্থগিত করে রেখেছে। বেশিরভাগ মামলাতেই রেলওয়ের পক্ষে রায় এসেছে। আমরা এখন শক্ত হাতে সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করবো।’

রেল সূত্রে জানা গেছে, ১৮৯৫ সালে ফুলবাড়িয়াতে ছোট্ট একটি রেল স্টেশন স্থাপন করা হয়েছিল। এরপর ১৯২০ সালে ফুলবাড়িয়ার আশেপাশের জমি তৎকালীন সরকার রেলওয়ে স্টেশনের জন্য অধিগ্রহণ করে। ১৯৬৮ সালে ফুলবাড়িয়া থেকে রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুরে স্থানান্তর করা হয়। এরপরই মূলত ফুলবাড়িয়ার রেলওয়ের সম্পত্তির দিকে কুনজর পড়ে একটি চক্রের। ভুয়া দলিল বানিয়ে তারা রমনা মৌজার সিএস ১৩৬, ১৩৮ ও ১৩৯ নং দাগের ৩.৯৭ একর জমি দখল করে।

এ সংক্রান্ত নথি ঘেঁটে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে রেলপথ বিভাগ, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, ভূমি সংস্কার ও ভূমি প্রশাসন মন্ত্রণালয়, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়াধীন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর সমস্ত সম্পত্তি বেআইনি দখল হতে উদ্ধার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এসব ভূমিতে উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়ার জন্য তিনি পূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী পূর্ত মন্ত্রণালয় ১৯৭৫ সালের ১১ মার্চ ৮০০ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীকে ৫ হাজার টাকা করে জমা দিয়ে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

রেল সূত্র জানায়, আনন্দবাজার এলাকার মোট ৩.৯৭ একর জমির মধ্যে ১.১০ একর জমি আনন্দবাজার বণিক সমিতিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর আগেই ১৯৭৪ সালে বাকি ২.৮৭ একর জমি দখলের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরুদ্ধে মীর্জা আশ্রাফ নামে এক ব্যক্তি ১৯৭৪ সালের একটি মামলা দায়ের করেন। এরপর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মীর্জা আশ্রাফ গং, নাজমা বেগম গং, হারুণ অর রশিদ গং এবং শাহজাদী বেগম ওয়াকফ বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা দায়ের করে। যদিও ২১টি মামলার মধ্যে ১৯টি মামলারই রায় রেলওয়ের পক্ষে গেছে।

কিন্তু মামলা চলাকালীন রেলওয়ে সম্পত্তির ভুয়া দাবিদাররা বিভিন্ন ব্যক্তির কাজে জমি বিক্রি করে দেয়। মীর্জা আশ্রাফের কাছ থেকে জমি কেনার সূত্র ধরেই আনন্দবাজারে চামেলী পরিবার নিজের আধিপত্য বিস্তার করে।

একাধিকবার হাতবদল
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে আনন্দবাজারে বাংলাদেশ রেলওয়ের জমি দখলকারীরা একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছেন। সেই জমির ক্রেতারা আবার অন্যের কাছে বিক্রি করেছেন সরকারি এসব সম্পত্তি। এভাবেই একাধিকবার হাতবদল হয় রেলওয়ের এসব জমি।

আনন্দবাজার বণিক সমিতির বরাদ্দকৃত জমি বাদে বাকি ২.৮৭ একর জমির মালিকানা দাবিদারকারী হয়েছেন ৯৬ জন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন সংরক্ষিত আসনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলী।

এ সংক্রান্ত নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, মীর্জা আশ্রাফের দখলে থাকা অবস্থায় এই জমির দেখাশোনা করতেন চামেলীর বাবা সিরাজুল ইসলাম। ১৯৭৮ সালে মীর্জা আশ্রাফ সিরাজুল ইসলামকে ৫ শতক জমি দান করেন। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম সে সময় ৫ এর আগে ৪ বসিয়ে মোট ৪৫ শতাংশ জমি লিখে নেন। মীর্জা আশ্রাফ এই জালিয়াতির অভিযোগে একটি মামলাও করেছিলেন।

যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ের (পূর্ব) বিভাগীয় এস্টেট অফিসের আইন কর্মকর্তা সালাউদ্দীন আহমেদ বলেন, রেলওয়েকে আটকানোর জন্য একটি চক্র একের পর ভুয়া মামলা দায়ের করেছিল। এর মধ্যে অনেক মামলাই খারিজ হয়ে গেছে। আমরা রেলের জমি রেলের দখলে নেয়ার চেষ্টা করছি।

দখলদারদের সঙ্গে রেল কর্মকর্তাদের যোগসাজশ
রেলওয়ে এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মীর্জা আশ্রাফের কাছ থেকে কেনা জমির সূত্র ধরেই চামেলীর পরিবার আনন্দবাজারে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। চামেলী নিজে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যরা বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। এ কারণে সব সরকারের আমলেই তারা আধিপত্য ধরে রেখেছেন।

সূত্র জানায়, রেলওয়ের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা নেপথ্যে থেকে দখলদারদের সহযোগিতা করে আসছেন। বিনিময়ে পাচ্ছেন মোটা অংকের মাসোহারা, যাতে জমি পুনরুদ্ধারে রেলওয়ে জোরালো কোনও ভূমিকা না রাখে। দখলদারদের পক্ষ হয়ে পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন কাউন্সিলর চামেলী নিজেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, মাঝেমাঝেই উচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য প্রত্যেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৪-৫ হাজার টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিমাসে মামলার খরচের জন্য তাদের কাছে ৫শ’ টাকা ‘ফি’ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

ওই সূত্র জানায়, এই দীর্ঘ সময়ে রেল কর্তৃপক্ষ মাত্র দুবার নিজেদের সম্পত্তি উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিল। ২০০৭ সালে এবং ২০১১ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পুলিশ এবং র‌্যাবের সহায়তায় উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়ে দখলদারদের কাছে বাধা পেয়ে ফিরে আসে। অবশ্য ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দেওয়ার অভিযোগে শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় কাউন্সিলর চামেলীর স্বামী আবুল হোসেন টাবু, দুই ভাই সফিকুল ইসলাম স্বপন ও সামসুল ইসলাম লাবলু, মা মমতাজ ইসলাম, দখলদার হারুন অর রশিদ, হাফিজ, ওয়াহিদুজ্জামানের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়।

পরে ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর রেলওয়ের পক্ষ থেকে আবারও উচ্ছেদ অভিযানের জন্য পুলিশি সহায়তা চেয়ে একাধিক চিঠি চালাচালি হলেও রহস্যজনক কারণে অভিযান পরিচালিত হয়নি।

সিটি করপোরেশনের গাফিলতি
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, আনন্দবাজারের ৩.৯৭ একর জমি ১৯৮৪ সালে আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনটি শর্তে ব্যবস্থাপনার জন্য তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। শর্ত তিনটি হলো−ভূমির মালিকানা স্বত্ব রেলওয়ের থাকবে, মোট আয়ের ৫ শতাংশ রেলওয়েকে দিতে হবে এবং ধরন/আকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশন এই ভূমি যথাযথভাবে সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও মামলা পরিচালনা না করায় এই সম্পত্তির মালিকানা হুমকির মুখে পড়েছিল। পরে ২০০৬ সালের ১৯ অক্টোবর তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে সিটি করপোরেশনকে দেওয়া বরাদ্দ বাতিল করা হয়।

রেল সূত্র জানায়, আনন্দবাজারসহ রেলওয়ের মোট ১২টি মার্কেট ব্যবস্থাপনার জন্য সিটি করপোরেশনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। শর্ত অনুযায়ী আয়ের ৫ শতাংশ রেল কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার কথা থাকলেও ১৯৯৩ সালে একবার মাত্র ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা জমা দিয়েছিল।

রেল সূত্র জানায়, ২০১০ সালে রেলওয়ের মালিকানাধীন ৩.৯৭ একর জমির মধ্যে ১.১০ একর জমিতে আনন্দবাজার বণিক সমিতিকে বরাদ্দ দেয়। পরে আনন্দবাজার রেলওয়ে সুপার মার্কেট লি. নামে এটি পরিচালিত হলেও বরাদ্দকৃতরা অনেকেই চামেলী পরিবারের দাপটের কারণে দোকানের দখল নিতে পারেনি। এ কারণে যাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে বকেয়া লাইসেন্স ফিও আদায় করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলী সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘মীর্জা আশ্রাফ গংয়ের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে এই সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন আমার বাবা। এটা নিয়ে রেলওয়ের সঙ্গে আমাদের মামলা চলছে। এই জমিতে আদালতের স্টে অর্ডার আছে। স্টে অর্ডার থাকাকালীন রেল এখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারে না।’

আনন্দবাজারের অবৈধ দখলদারদের হয়ে সমন্বয় ও চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি সত্য নয়। এখানে ৯৬ জন মালিক রয়েছে। সবাই যৌথ ও এককভাবে মামলা করেছে। সবাই মিলে মামলার খরচ চালানো হয়।’