শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারীর চোখে ‘নারী স্বাধীনতা’

নিজস্ব সংবাদদাতা : বর্তমান সময়ে ‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নারীর অধিকার আদায়ে স্বোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে অনেককেই। আবার শব্দটি নিয়েই ঘোর আপত্তি তুলছেন কেউ কেউ। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত নারী শিক্ষার্থীরা এটি নিয়ে কী ভাবছেন? সেই ভাবনাগুলো ভাবনা তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেন আজাদ।

কথায় কথায় প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করাই হলো নারী স্বাধীনতানারী স্বাধীনতা বলতে বুঝি নারীকে কটাক্ষ না করা, অবহেলিত না ভাবা, নারীর চিন্তাশক্তি ও মেধার মূল্যায়ন করা এবং প্রতিভা বিকাশে বাঁধাগ্রস্থ না করা। যোগ্যতার প্রশ্নে কাউকে হেয় না করা বা নারী হয়ে পুরুষের মতো কাজ করছো কেন এমন প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করা। নারী স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ নারী ও পুরুষের মধ্যে বিভেদ বা বৈষম্য সৃষ্টি না করা। নারী কর্মক্ষেত্রে উপার্জন করে তার জীবিকা নির্বাহ করবে!! এই মান্ধাতা আমলের চিন্তা-ভাবনা সকলের মন থেকে মুছে ফেলার নামই হলো নারী স্বাধীনতা। জাতি গঠনে নারীর অংশগ্রহণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সর্বপ্রথমেই প্রয়োজন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত সুযোগ। সর্বক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের অধঃস্তন বা প্রতিযোগী না ভেবে সহযোগী হিসেবে গণ্য করতে হবে।
মারজুকা রায়না,শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নারী স্বাধীনতা নারীর জীবনের সৃষ্টিশীলতা, ইন্দ্রিয়ের স্বাধীনতা, সুখের সন্ধানে পথ চলা, প্রতিটি মুহূর্ত স্বাধীনভাবে উপভোগ করা, স্বাধীনভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করার মাধ্যমে ক্রমশ বেড়ে ওঠার সংগ্রামের নামই নারী স্বাধীনতা। নারী স্বাধীনতার মূল বিষয়গুলো শুধুমাত্র গ্রন্থে বন্দী হয়ে থাকার জন্য নয়; বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন জরুরি। জ্ঞানার্জন, আত্মসংযম, শ্রমনিষ্ঠা, সেবা, দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে মানসিক দাসত্বের কঠিন শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভই হলো স্বাধীনতা। অন্যায়, কুসংস্কার, অসত্যের সাথে বিদ্রোহ করে নারী-পুরুষ পরস্পর আত্মসম্মানবোধ নিয়ে মানুষ হিসেবে সম্মানীত হোক, সকলের অধিকার সমুন্নত থাকুক, এটিই কাম্য।
মোমেনা আক্তার, শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নারী স্বাধীনতার অর্থ চিন্তার বাস্তবায়ন করাজনৈক নারী বলেছিলেন, ‘আমি হৃদয় দিয়ে বিশ্ব জয় করবো। নয় উগ্রতা দিয়ে, নয় স্বেচ্ছাচারিতা’। নারী স্বাধীনতা মানে হলো নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিজের সুস্থ চিন্তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারা। নারী প্রথমেই তার পরিবারে পরাধীনতার শেকলে বন্দী হয়। ভাইয়ের সাথে ঝগড়া থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে নির্বিচারে শুনতে হয় ‘মানিয়ে নাও, মানিয়ে নাও’। কোন ক্ষেত্রেই নারীর মতামত প্রতিষ্ঠা তো দূরে থাকুক, মুখ দিয়ে তা বের করারই সুযোগ হয় না। আবার কাউকে দেখা যায় নারী অধিকারের কথা বলে উগ্রতা প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা করে। নারীকে নারী হিসেবে নয়; মানুষ হিসেবেই বাঁচতে দেওয়া উচিত।
শ্যামলী তানজিন অনুশিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
মতামতের গুরুত্ব দেওয়া প্রকৃত নারী স্বাধীনতাকবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় বলেছেন- ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়’। স্বাধীনতা শব্দটির অর্থ হচ্ছে পরের অধীন নয় এমন। কেউ কখনো পরাধীন থাকতে চায় না। স্বাধীনতা সবাই চায়, পরাধীনতার বেড়ি যেন সুখ কেড়ে নেয়। বনের পাখিকে যদি সোনার খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়, রাজকীয় খাবার দেওয়া হয়, তবুও সে ডানা ঝাঁপটায় এবং ছটফট করে। কারণ পাখি চায় চায় স্বাধীন হয়ে আকাশে উড়তে। তেমনি একজন নারীও স্বাধীনতা চায়। আজ নারীরা শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, এভারেস্ট জয়ী, স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে নারীরা নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে, তবুও অনেক ক্ষেত্রে আজ নারীরা অবহেলিত। পরিবার থেকে কোথাও মতের গুরুত্ব দেওয়া হয়না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সৃষ্টি করা হয় কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা। আধুনিকতার যুগে আজও পথ চলতে, কথা বলতে নারীর চোখে ভয় খেলা করে। প্রত্যেকের উচিত নারীকে প্রতিযোগী না ভেবে সহযোগী ভাবা।
জেলি আক্তার,শিক্ষার্থী, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ
নারী স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে প্রতিভার বিকাশে বাঁধা না দেওয়াসংস্কৃত শব্দ নৃ (নৃ+ঈ) থেকে নারী শব্দটির আবির্ভাব। আর স্বাধীনতা হলো স্ব+অধীনতা, স্বীয় অধিকার। আজকাল নারী স্বাধীনতার কথা ভীষণভাবে শোনা যাচ্ছে। নারী স্বাধীনতা আবার কী! আমার দৃষ্টিকোণে নারী মানেই স্বেচ্ছাচারিতা নয়, নারী মানেই পুরুষত্বতা নয়, নারী মানেই উগ্রতা নয়। নারী শুধুই নারী। যার কোন বিকল্প নেই। আমাদের সমাজের চোখে নারী শব্দটি মানেই মানিয়ে নেয়া, মেনে নেওয়া। কিন্তু কেন? সর্বদা নারীকেই কেন মুখ বুঝে সহ্য করতে হবে! নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক পরিবারে মেয়েকে সাইকেল চালানো পর্যন্ত শিখতে দেওয়া হয় না। অথচ বর্তমানে নারীরা ট্রেন, জাহাজ, বিমান চালানোসহ মহাকাশযানে পৃথিবী পাড়ি দিচ্ছে। তবে টিভি বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীর দেহ উপস্থাপন করে নারীকে পণ্য বানিয়ে পণ্যের প্রচারণা চালানো, নির্বিঘ্নে ড্যান্সবার বা নাইট ক্লাবে যাতায়াত কখনোই নারী স্বাধীনতা হতে পারে না। নারী স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে কোনরূপ বাঁধা না দেওয়া।
সামসুন নাহার,শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নারী স্বাধীনতা মানে উচ্ছশৃঙ্খলতা নয়নির্ধারিত সীমারেখা ও শালীনতার মধ্যে নিজের ভালো লাগা, ভালো থাকা, পরিবারসহ সর্বক্ষেত্রে নিজের মত প্রকাশের অধিকার এবং এর মূল্যায়নকেই আমার কাছে নারী স্বাধীনতা মনে হয়। এটিও সত্য যে, নারী স্বাধীনতা ব্যক্তির আদর্শ ও দর্শনের উপর নির্ভর করে। কারো কাছে উচ্চতর শিক্ষালাভ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা, সর্বক্ষেত্রে নিজের মতামত বা ইচ্ছের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া হলো নারীর স্বাধীনতা। আবার কারো কাছে নাইট পার্টি, হ্যাংআউট প্রভৃতি হলো নারী স্বাধীনতা। তবে উচ্ছশৃঙ্খলতা কখনোই নারী স্বাধীনতার অংশ হতে পারেনা।
সাদিয়া শারমিন আশাশিক্ষার্থী, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ
নারী স্বাধীনতা শব্দটিই কৌতুকময়‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দগুচ্ছ আমার কাছে বেমানান মনে হয়। আমরা নিজস্ব চিন্তা-চেতনার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে সমাজে এমন কিছু ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছি যা কালের বিবর্তনে একটি সার্বজনীন মাথা ব্যথায় রূপ নিয়েছে। নারী স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে যে অনাচার আজকের সমাজে তৈরি হয়েছে তা একদিনে নয়; বরং দীর্ঘদিন পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের অবনতির প্রভাবমাত্র। নারীকে পরাধীন করে রাখা যেমন অন্যায়, তেমনি সর্বক্ষেত্রে নারী স্বাধীনতা বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে পুরুষের সমান দাবি করা ও প্রতিযোগী জীবনযাপন শুধু কষ্টকর নয়; বরং নিন্দনীয়ও বটে। তথাকথিত বাধহীন নারী স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সমাজে বেহায়াপনা ও ব্যভিচারপূর্ণ জীবন পদ্ধতিকে অনুকরণ করাকে আমার কাছে নেহাৎই কৌতুকময় মনে হয়। অসম্মানিত, সম্ভ্রমহীন এবং শত্রুভাবাপন্ন প্রতিযোগী মনোভাব পোষণ করে নারী তার যে নিজস্ব স্বকীয়তা হারাচ্ছে, তাকে আদৌ নারীর সুষ্ঠু স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা বলে কি না তা আমার বোধগম্য নয়। সৃষ্টিগতভাবে নারীসমাজ যে সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্ত হয়ে এসেছে তা বহাল রাখা, যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নারীত্ব বিকশিত করার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মধ্যেই নারীর প্রকৃত অগ্রযাত্রা নিহিত।মিথিলা মুক্তা,শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
শব্দটিই বিদঘুটেস্বাধীনতা শব্দটি তখনই সামনে আসে যখন কেউ পরাধীন থাকে। নারীর স্বাধীনতা দাবী বা আন্দোলন করলে প্রশ্ন আসে নারীকে পরাধীন করলো কে? কোথায়ই বা স্বাধীনতা দরকার? প্রাথমিক হয়ে উচ্চশিক্ষা থেকে চাকুরিক্ষেত্রে সর্বত্রই নারী পুরুষের সমানাধিকার বিদ্যমান। আমার কাছে নারী স্বাধীনতা শব্দটিই বিদঘুটে ও বেমানান। 
মাহফুজা আক্তার মৌ,শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ।

সংকলনে: মো. আখতার হোসেন আজাদ

শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম।