বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাত মাস ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে না

নিজস্ব সংবাদদাতা : বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর আগেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করেছে। প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। ঝরে পড়ার হারও কমেছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সাত মাস ধরেই বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনেক শিক্ষার্থীরই স্কুলের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগই নেই। তাদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে না বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই ঝরে পড়ার হার নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

গত বছর প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। ঝরে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য, বাল্যবিয়ে ও আবাসস্থল ত্যাগ। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়ে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে।

বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। করোনার কারণে আরো ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির প্রভাবে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। অনেক ক্ষেত্রে তারা কোনো রকমে তিন বেলা খেতে পারলেও পুষ্টিমান রক্ষা করতে পারছে না।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী বলেন, ‘করোনায় যে অবস্থা তাতে ঝরে পড়ার হার বাড়বে। করোনার এই ক্রান্তিকালে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করবে। বাল্যবিয়ে বেড়ে যাবে। বিশেষ করে চর, হাওর ও শহরের বস্তি অঞ্চলের শিশুরা বেশি সমস্যায় পড়বে। শুধু প্রাথমিক-মাধ্যমিকই নয়, যেসব শিক্ষার্থী প্রাইভেট-টিউশনি করিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, তাদের মধ্যেও ঝরে পড়ার হার বাড়বে।’

এই শিক্ষাবিদ পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘ঝরে পড়ার হার কমাতে সরকারকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য এবারের বাজেটে শুধু শিক্ষা খাতেই ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার কথা আমরা বলেছি। যেসব মেগাপ্রকল্প আছে, যেগুলোর ধীরে চলা যেতে পারে, সেগুলো থেকে বরাদ্দ কমানো যেতে পারে। তবে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, শিক্ষার ক্ষতি করা যাবে না। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের স্কুলে ধরে রাখতে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে।’ 

করোনায় পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে; কিন্তু এখানেও বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে ক্লাসগুলো দেখতে পারলেও গ্রামাঞ্চলে তা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবারে এখনো টেলিভিশন নেই। আর সংসদ টেলিভিশন ডিশ সংযোগের মাধ্যমে দেখতে হয়; কিন্তু অনেকের টিভি থাকলেও ডিশ সংযোগ নেই। ফলে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে এখন বেতারেও প্রাথমিকের ক্লাস প্রচার করা হচ্ছে।

এ ছাড়া শহরাঞ্চলের নামিদামি স্কুলগুলো নিজেরাই জুম, গুগলসহ নানা মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। শিক্ষকরা ভাগ ভাগ করে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এসব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তারা পিছিয়ে পড়ছে। দরিদ্র পরিবারের যেসব শিক্ষার্থী শিক্ষার বাইরে আছে, তারা পড়ালেখায় আর না-ও ফিরতে পারে। এ ছাড়া অনেক দরিদ্র পরিবারই তাদের সন্তানদের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাজে নামিয়ে দিতে পারে। এতে ঝরে পড়ার হার বাড়বে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, ‘ঝরে পড়ার হার বাড়ার অন্যতম কারণ দারিদ্র্য, বাল্যবিয়ে ও অভিভাবকদের থাকার জায়গা পরিবর্তন করা। এই চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। যেহেতু অনেক অভিভাবক গ্রামে চলে গেছেন, তাই একজন শিক্ষার্থী যেখানেই থাকুক না কেন, সেখানে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট (টিসি) ছাড়া সে ভর্তি হতে পারবে। ঝরে পড়তে পারে, এমন বাচ্চাদের প্রতিটি স্কুল থেকে চিহ্নিত করার কাজ চলছে। শিক্ষকরা প্রয়োজনে ওই শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের বোঝাবেন। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। স্কুলে স্কুলে মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগ নেওয়ার ফলে আমরা মনে করছি, ঝরে পড়ার হার আগের বছরের তুলনায় তেমনভাবে বাড়বে না।’

ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত কর্মকর্তা মাছুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায় থেকে যে খবর পাচ্ছি, তাতে ৪০ শতাংশ বা এর চেয়ে কিছু বেশি শিক্ষার্থী বতর্মানে নিয়মিতভাবে সংসদ টেলিভিশন দেখছে ও পড়ালেখা করছে। ফলে কিছু শিক্ষার্থী স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে থাকছে। আর করোনার প্রভাবে যদি দারিদ্র্যের হার বেড়ে যায়, তাহলে অনেক শিক্ষার্থীকে তার পরিবার কাজে লাগিয়ে দেবে। এতে ভয় করা হচ্ছে, অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে না।’

স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘ঝরে পড়ার হার কমাতে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে স্কুল ও বই-খাতার পেছনে যেন দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের কোনো অর্থ খরচ করতে না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকার বিশেষ কোনো বৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারে।’