শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ বদলি পেনশন মানেই মালেক সিন্ডিকেট

নিজস্ব সংবাদদাতা : একীভূত থাকা অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং পরে গঠিত স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নিয়োগ, বদলি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনের টাকা তোলার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সিন্ডিকেট গড়েন আব্দুল মালেক ওরফে মালেক ড্রাইভার ওরফে বাদল হাজি। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কয়েকজন নেতারও রয়েছে গভীর সম্পর্ক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সংগঠনের নেতা পরিচয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে তদবির বাণিজ্য চালিয়েছেন। শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক গাড়িচালক মালেক অস্ত্র ও জাল টাকাসহ গ্রেপ্তারের পর তাঁর সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পেয়েছেন র‌্যাবের তদন্তকারীরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেনের সময় দুই বছরে দেশজুড়ে তদবির বাণিজ্যে অন্তত ১০০ জন স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ দিতে সক্ষম হয়েছেন মালেক। দুই অধিদপ্তরের প্রশাসন ও পেনশন বিভাগে মালেকের পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা তাঁর পক্ষে কাজ করে। মালেকের তদবির না শুনলে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের পড়তে হতো মহাবিপদে। স্বাস্থ্য বিভাগ ঘিরে রয়েছে মালেকের নিজস্ব ‘সাংবাদিক’ সিন্ডিকেট। অখ্যাত কিছু সংবাদপত্রে মালেকের কথার বাইরে চলা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফলাও করে সংবাদ ছাপা হতো। শীর্ষপর্যায়ে সম্পর্ক এবং কথিত সাংবাদিক সিন্ডিকেটের কারণে অনেক কর্মকর্তা তাঁকে ভয় পেতেন। গাড়িচালক হলেও অনেক ক্ষমতার অধিকারী মালেকের বিরুদ্ধে মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস জালিয়াতির তথ্যও পেয়েছেন তদন্তকারীরা। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) একটি চক্রকে শনাক্ত করেছে, যে চক্রে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রেসের কর্মী আব্দুস সালাম অন্যতম হোতা। এই সালামের সঙ্গে মালেকের রয়েছে ভালো সম্পর্ক। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এদিকে গতকাল সোমবার তুরাগের দক্ষিণ কামারপাড়ায় বামনের টেক এলাকায় মালেকের সাততলা বাড়িতে গিয়ে রাজপ্রাসাদের ডিজাইনের দরজা দেখা গেছে। মালেকের সম্পদ পারিবারিক বলে দাবি করছেন স্বজনরা। তবে এলাকাবাসী জানত না মালেক গাড়িচালক। তারা তাঁকে বাদল হাজি নামে চিনত। গতকাল মালেককে তুরাগ থানায় করা অস্ত্র ও জাল টাকার মামলায় সাত দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন ঢাকা মহানগর হাকিম শহিদুল ইসলামের আদালত। গতকালই মালেককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বিপুল সম্পদ রক্ষায় অবৈধ অস্ত্র বহন করতেন ড্রাইভার মালেক। অনেক টাকা লেনদেনের সময় জাল টাকা ব্যবহার করতেন। তাঁর ফৌজদারি অপরাধের তথ্য পেয়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। এরপর তাঁর অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে অবাক হয়েছি। এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁকে তলব করেছে। এ ছাড়া মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে সিআইডি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখবেন বলে আমরা মনে করি। তদন্তের প্রয়োজনে চাইলে র‌্যাব তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করবে।’

যেভাবে র‌্যাবের জালে : র‌্যাবের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, গোপন সূত্রের মাধ্যমে তুরাগ এলাকায় কয়েকজন ব্যক্তির অবৈধ কর্মকাণ্ড এবং বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এদের অন্যতম মালেক ড্রাইভারের ফৌজদারি অপরাধ আছে কি না তা দেখা হয়। নজরদারির পর অভিযান চালিয়ে তাঁর বাড়িতে অস্ত্র ও জাল টাকা পাওয়া গেছে। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অবৈধ কারবারে বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া যায়। র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব বিষয় আমাদের তদন্তের আওতায় পড়ে না। তাই অস্ত্র আর জাল টাকার বিষয়ে আমরা মামলা করেছি। সংশ্লিষ্ট সংস্থা এ ব্যাপারে তদন্ত করবে।’

খুঁটির জোরে গড়েন বাণিজ্যের সিন্ডিকেট : র‌্যাব, পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, অস্টম শ্রেণি পাস মালেক ১৯৮২ সালে সাভারে একটি স্বাস্থ্য প্রকল্পে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়। এরপর তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি এবং পরে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজির গাড়িচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সাবেক ডিজি অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেনের আমলে অন্তত ১০০ জন স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগে তদবির করেছেন মালেক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদ্যোবিদায়ি মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান ফকির, প্রধান সহকারী সৈয়দ জালাল, অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলমসহ পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে মালেকের।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক ডিজি শাহ মনির হোসেন তা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার সময় কমিটির মাধ্যমে সব নিয়োগ হতো। তত্কালীন মন্ত্রীসহ সবাই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে সে সময় নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগ ছিল না বলে মনে করি।’ 

বর্তমানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি এ এফ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক হিসেবে তাঁর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ছিলেন মালেক। এমন অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিজি বলেন, ‘তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’ 

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা মেনে সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবহিত করেছি। তাঁর অপরাধের ব্যাপারে মামলা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে পরে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীরা সেটি দেখবেন।’

প্রশ্ন ফাঁসের সিন্ডিকেট মালেকের ঘনিষ্ঠ : একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি সিআইডি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মেডিক্যাল ও ডেন্টালের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে ভর্তি জালিয়াতির অভিযোগে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ চক্রের অন্যতম হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে মুন্নু তাঁর খালাতো ভাই এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রেসের কর্মী আব্দুস সালামের সহায়তায় জালিয়াতি করেছে। এই চক্রে জড়িত জেড এম এ সালেহীন শোভন নামে এক চিকিৎসক। প্রেসকর্মী সালামসহ সিন্ডিকেটের কয়েকজনের সঙ্গে মালেকের যোগাযোগ ছিল বলে তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য শিক্ষার তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির নেতা মালেক। ফলে সম্পর্ক থাকতে পারে। বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছে।

স্বাস্থ্যসচিব আব্দুল মান্নান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মালেকসহ যারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সবাইকে ধরা হবে। এই প্রক্রিয়া চলছে।’

এলাকার লোকজনের বিস্ময় : রাজধানীর তুরাগের কারাগারপাড়ার বামনের টেকের ৪২ নম্বর বাড়ি ‘হাজী কমপ্লেক্সে’ পৌঁছে স্থানীয়দের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ড্রাইভার মালেকের বাড়িটি কোথায়? তবে কেউ নামের সঙ্গে মিলিয়ে সন্ধান দিতে পারেননি। শেষে গরুর খামারসহ পুরো বিবরণ দিলে স্থানীয় লোকজন বাড়িটি বাদল হাজির বলে জানান। মালেক যে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের গাড়িচালক হয়ে কোটিপতি এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন তা অনেকে জানেন না। রাশেদ হোসেন নামে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘তিনি তো ধনী মানুষ। গাড়িচালক জানতাম না।’ সাততলা বাড়িটির ১৪ ফ্ল্যাটের মধ্যে তিনতলা ছাড়া অন্যসব ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়ারা থাকেন। তৃতীয় তলার মালেকের ফ্ল্যাটে রাজপ্রাসাদের মতো খোদাই করা নকশার দামি দরজা। কলিংবেল টিপতে বেরিয়ে আসেন তাঁর মেয়ে নাজনীন সুলতানা। পরিচয় পেয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মিডিয়ায় আপনারা র‌্যাব যা বলছে, তা-ই লিখছেন। আমাদের এত সম্পদ নেই।  একটি বাড়ি আমাদের। ১৫ কাঠার জায়গায়, তাও ৭০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এটি করা হয়েছে। আর গরুর খামার আমার দাদারই ছিল।’

টাকা পাচার করেছেন বিদেশে : সূত্র জানায়, গত বছরের ১৬ অক্টোবর জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মালেককে চিঠি দিয়ে তলব করে। আগামী ২২ অক্টোবর মালেককে হাজির হতে বলেছে দুদক। মালেকের অর্থপাচারের তথ্য পেয়ে তা খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এরই মধ্যে উত্তরার গরিবে নেওয়াজ এভিনিউর প্রাইম ব্যাংকের শাখায় তাঁর চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। মালেকের প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগের দক্ষিণ কামারপাড়ায় রমজান মার্কেটের উত্তর পাশে তৈরি করা হয়েছে হাজি কমপ্লেক্স। ধানমণ্ডি মৌজার হাতিরপুল এলাকায় সাড়ে চার কাঠা জমিতে ১০ তলা ভবন নির্মাণাধীন। তাঁর বড় মেয়ে বেবীর নামে দক্ষিণ কামারপাড়া এলাকায় ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার রয়েছে।