বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অনিয়মের বেসরকারি হাসপাতাল চালাচ্ছেন সরকারি ডাক্তাররা

নিজস্ব সংবাদদাতা : সরকারি চাকরি করছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় কোনো না কোনো সরকারি হাসপাতাল কিংবা মেডিক্যাল কলেজে। সরকারি বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন ঠিকঠাক। এমন অনেক সরকারি চিকিৎসক রীতিমতো মালিক হয়ে হাসপাতালের ব্যবসাও করছেন। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেই অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে এসব হাসপাতালের।

আবার অনেকে অনুমোদন ছাড়াই নিজের হাসপাতাল চালাচ্ছেন নামে-বেনামে। অনেক হাসপাতালে অনকলের নামে নিয়মিত চাকরিও করছেন। যখনই অনিয়মে জড়িত বা নিবন্ধনহীন কোনো হাসপাতালের খোঁজ মেলে, তখন কৌশলে আড়াল হয়ে যান এসব সরকারি ডাক্তার। এমন পরিস্থিতি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় থাকেন চিকিৎসক সংগঠনের নেতারাও।

এমন অনিয়মের মধ্যেও বেসরকারি অনেক হাসপাতালেই মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত নার্সও নেই।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় হাসপাতাল পাড়া হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদপুর এলাকা। রোগীকেন্দ্রিক যত অঘটন তার বেশির ভাগই ঘটে এই এলাকার কোনো না কোনো হাসপাতালে। সর্বশেষ এই মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার একটি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নামের অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে, যে প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদনই ছিল না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের।

ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত কয়েকজন চিকিৎসক, যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন বলে জানা গেছে।

মোহাম্মদপুরের ২০/৩ বাবর রোডে রয়্যাল মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল। একই হাসপাতালের আরেকটি শাখা রয়েছে গজনবী রোডে মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে। গতকাল শনিবার বাবর রোডে রয়্যাল মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালে গিয়ে হাসপাতালটির মালিক কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী এ প্রতিবেদককে বলেন, অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন। কোন হাসপাতালের চিকিৎসক তিনি—এমন প্রশ্নের মুখে ওই কর্মচারী বলেন, আগে ওই এলাকার সরকারি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে ছিলেন, পরে বদলি হন কুষ্টিয়ায়। এখন সেখান থেকে বদলি হয়ে এসেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।

সরকারি চাকরি করে দুটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক বা পরিচালনায় যুক্ত থাকতে পারেন কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. মো. আবিদ হোসেন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় ফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি কেন এসব জানতে চান, আপনার কী দরকার, আপনি কেন ফোন করেছেন?’ পরে শান্ত হয়ে বলেন, ‘আমি এই হাসপাতালের মালিক নই, মালিক আমার স্ত্রী।’

হাসপাতালটির লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে কি না জানতে চাইলে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে, ইতিমধ্যেই আমি কাগজ হাতে পেয়েছি।’

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁর দুটি হাসপাতালের মধ্যে একটির লাইসেন্স থাকলেও আরেকটির নেই। বাবর রোডের হাসপাতালটির লাইসেন্স আছে, মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের হাসপাতালের লাইসেন্স নেই।

এর আগে বাবর রোডের হাসপাতালের ভেতরে বিভিন্ন ডাক্তারের নাম-পরিচয় তালিকা এবং ওয়েবসাইটেও দেখা যায় অধ্যাপক ডা. মো. আবিদ হোসেনের নিজের দীর্ঘ পরিচয়। তালিকায় কমপক্ষে আরো ২০ জন চিকিৎসকের নাম রয়েছে, যাঁরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (নিটোর), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রাইভেট কোনো প্রতিষ্ঠানের তালিকা কিংবা পরিচালনায় থাকার সুযোগ নেই। কেউ যদি থাকেন, সেটা অবৈধ। এ ছাড়া কোনো হাসপাতালের একাধিক শাখা থাকলেও প্রতিটির জন্য আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে।’

শুধু ওই একটিই নয়, রাজধানীর ওয়ারী ১১/১ হেয়ার স্ট্রিটে পরিচালিত নিবেদিতা শিশু হাসপাতাল লিমিডেটের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে এক বছর আগে। লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই চলছে হাসপাতালটি। কর্তৃপক্ষ বলছে, আবেদন করেও নতুন লাইসেন্স হাতে পায়নি তারা। গত বছরের ১৪ নভেম্বর হাসপাতালটির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মেয়াদ বাড়ানোর জন্য টাকা জমা দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন কাগজপত্রের চাহিদা মেটানোর পর চলতি বছরের ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মেইল থেকে তাদের জানানো হয়, আবেদন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এখনো লাইসেন্স পায়নি কর্তৃপক্ষ। অথচ আবেদন করে না পাওয়া লাইসেন্সের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে গত শুক্রবার।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. মুজিবুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যথাযথ নিয়মে আবেদন করেছি; কিন্তু লাইসেন্স পাইনি। পরে সামনের বছরের জন্যও আবেদন করে রেখেছি।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসপাতালটিতে ৩৫টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে কেবিন রয়েছে ১১টি। অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী প্রতি ১০ আসনবিশিষ্ট ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালের জন্য নিয়মিত তিনজন চিকিৎসক, ছয়জন নার্স ও দুজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকার কথা। এ ছাড়া কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও বাধ্যতামূলক রাখতে হয়। কিন্তু হাসপাতালটিতে চিকিৎসক সেই অনুযায়ী নেই; যদিও কর্তৃপক্ষের হিসাবে ১৮ জন চিকিৎসক ও ২৪ জন নার্স রয়েছেন। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে মাত্র একজন চিকিৎসক ও কয়েকজন নিবন্ধনহীন নার্স পাওয়া গেছে। নার্সদের বেশির ভাগই সুমনা হাসপাতাল থেকে সার্টিফিকেট কোর্স করে যোগদান করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নার্স বলেন, তাঁরা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর কাজ করছেন। এতে দোষের কী আছে?

এ বিষয়ে হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সার্জেন্ট খাজা আহম্মদ (অব.) এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ডিপ্লোমা, নন-ডিপ্লোমা ও সুমনা হাসপাতাল থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সরা কাজ করছেন। তাঁদের প্রয়োজনে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।’

ওই হাসপাতালের মালিকদের অন্যতম ডা. নীহার রঞ্জন সরকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। মালিকানার বিষয় জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার শেয়ার আছে ওই হাসপাতালে।’ তবে এর কিছুক্ষণ পরে তিনি নিজ থেকে আবার ফোন করে বলেন, ‘আসলে ওই শেয়ার আমার নামে না, আমার ভাইয়ের।’

গত শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডান পাশে প্যাথলজি কালেকশন বুথ। বাঁ পাশে রোগীদের বসার জায়গা। সামনে অভ্যর্থনাকক্ষ। এর পাশে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কক্ষ। এর পাশে রয়েছে হাসপাতালের ফার্মেসি। আর ডান দিকের সরু রাস্তা দিয়ে ভেতরে ক্যান্টিন। এর পাশে বাথরুম। পাশেই এক্স-রে কক্ষ। দেখা গেল, সিঁড়ির বাঁ পাশে চিকিৎসকের কক্ষ, যেখানে ৪০০ টাকা ফি নিয়ে রোগী দেখছেন চিকিৎসক।

মাত্র একজন চিকিৎসক কেন—জানতে চাইলে হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘অন্য চিকিৎসকরা হয়তো নামাজ পড়তে গেছেন। এমনিতে আমাদের সব সময় চিকিৎসক থাকেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভর্তি রোগীর স্বজন জানান, বিভিন্ন সময় শিশুর শারীরিক অবস্থা জানতে অথবা অবস্থা কিছুটা বেগতিক দেখলে কথা বলার জন্য বেশির ভাগ সময় কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায় না। তাঁরা তাঁদের সময়মতো এসে ফি নিয়ে রোগী দেখে চলে যান। হয়তো দিনে একবার কেউ একজন একটু রাউন্ড দিয়ে চলে যান। আর বেশি সমস্যাগ্রস্ত রোগীর জন্য তো কোনো ব্যবস্থাই নেই।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘একজন ডাক্তার যখন হাসপাতালের মালিক হবেন, তখন তিনি একজন ব্যবসায়ীও। ফলে তাঁকে তখন ব্যাবসায়িক নিয়ম-নীতি মেনে কাজ করতে হবে। তিনি যদি কোনো অন্যায় করেন, তবে চিকিৎসক হিসেবে আমরা তাঁর পাশে থাকব না। বরং এ ধরনের ঘটনায় আমরা শক্তভাবেই আইনগত পদক্ষেপ চাইব।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরো কঠোর হওয়া দরকার।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট ১৭ হাজার ২৪৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধন নিয়েছে। এর মধ্যে বিভাগ হিসেবে ঢাকায় পাঁচ হাজার ৪৩৬টি, চট্টগ্রামে তিন হাজার ৩৭৫টি, রাজশাহীতে দুই হাজার ৩৮০টি, খুলনায় দুই হাজার ১৫০টি, রংপুরে এক হাজার ২৩৬টি, বরিশালে ৯৫৭টি, ময়মনসিংহে ৮৭০টি এবং সিলেটে ৮৩৯টি রয়েছে। এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অর্ধেকের বেশির নিবন্ধন হালনাগাদ করা নেই। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, নবায়ন সম্পন্ন হয়েছে ১৩ হাজার হাসপাতালের আর নবায়নের প্রক্রিয়ায় আছে সাড়ে তিন হাজার হাসপাতাল। বাকিগুলোর নিবন্ধন নবায়ন করা হয়নি। এমনকি অনেক হাসপাতালের প্রথম নিবন্ধনের তালিকাও নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে।

অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. ফরিদ উদ্দিন মিয়া কয়েক দিন ধরে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করছেন। তিনি গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ঢাকায় ফিরে আরো নতুন কতটি নবায়ন হয়েছে কি হয়নি সেগুলো জানানো যাবে।’

বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া এ প্রতিবেদ্ককে বলেন, ‘আমাদের অনুরোধেই সরকার সময় বাড়িয়ে দিয়েছিল নিবন্ধনের জন্য। আমরাও বারবার বলেছি, যারা নিবন্ধন নবায়ন করেনি তারা নিয়ম-নীতি দ্রুত করে ফেলুন। যেসব হাসপাতাল বা ক্লিনিক নিবন্ধন নবায়ন করেনি, সেগুলোর কোনো মালিক ডাক্তার হলেও কিছু যায় আসে না। তাঁরা বৈধভাবে হাসপাতাল চালানোর উপযুক্ত নন।’