বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে সরকারকে ঝুঁকি নিয়ে এগোতে হবে

নিজস্ব সংবাদদাতা : করোনার প্রথম ঢেউ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সে কারণে ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি আবারও বাধার মুখে পড়তে যাচ্ছে কি না তা ভাবাচ্ছে সরকার, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিকদের।

তবে এ অবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে সরকারকে ঝুঁকি নিয়ে এগোতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে হিমশিম খেলে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে পারে। তাই প্রথম ঢেউ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগে থেকেই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় কাজ করতে হবে।

সিপিডির সিনিয়র গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “আমরা অনেক আগেই স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে নেমে গেছি। অনেক দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনও স্থবির। কিন্তু সীমিত হলেও আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেহেতু চলছে, তাই আমাদের ঝুঁকির মাত্রা কম হবে। ”

তিনি বলেন, “বড় অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য জড়িত। তাদের মন্দার প্রভাব আমাদের এখানে আসার একটা আশঙ্কা রয়েছে। তবে বিদেশি ক্রেতারা আমাদের পণ্য কেনা অব্যাহত রাখলেও আমাদের ঝুঁকি কম থাকবে।”

ঝুঁকি নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার যে কৌশল সরকার নিয়েছে, দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় তা অব্যাহত রাখতে হবে বলে তিনি মনে করেন। সেজন্য সরকারকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নজর রাখতে হবে।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “উদ্যোক্তাসহ সেবা খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তাদের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন হবে। ঘোষতি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। ”

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সরাসরি এবং পরোক্ষভাবেও আসবে। এতে অভ্যন্তরীণ অর্থিক সংকট আবারও তৈরি হবে। এই অর্থবছরে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না। রপ্তানি বাজারেও একটা প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ”

তিনি বলেন, “লকডাউনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। তবে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য সরকারকে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ”

করোনা দ্বিতীয় ঢেউ যদি আসে তবে তা প্রথমটার মতো ক্ষতি করতে পারবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অর্থনীতি সচল রাখতে সরকারকে একটু ঝুঁকি নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের সহযোগিতা ছাড়া সরকার কিছু করতে পারবে না। ”

তবে দ্বিতীয় ঢেউ এলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ফিরে আসা কঠিন হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কা থেকে সামগ্রিক অর্থনীতি সামলাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। অন্যান্য দেশের মতো লকডাউনের অনুরূপ পদক্ষেপে না গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কলকারখানা, মার্কেট ও শপিংমল চালু রাখার বিষয়ে একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে সমন্বয়ে গাঠন করা হয়েছে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ। স্বল্প আয়ের মানুষের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখবে সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা- টিসিবি।

বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন বলেন, “করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামলানোর জন্য সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর। অনেক দেশ লকডাউনে গেলেও আমাদের দেশে বাণিজ্য কর্মকাণ্ড পুরোপুরি চালু থাকবে। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি কার্যক্রমও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ”

তিনি বলেন, “পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করবে। এজন্য একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। এই গ্রুপের কো-চেয়ার হচ্ছেন দুই মন্ত্রণালয়ের সচিব। শীতকালে কোনো পণ্যের দাম আর বাড়বে না। ইতোমধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি হয়ে গেছে। পণ্যসামগ্রীর বিপণন যাতে ভালভাবে হয়, সেদিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ”

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে এবং তা মোকাবেলায় কী করা উচিত, তা নিয়ে কাজ করছে অর্থ বিভাগ। এরই মধ্যে বেশ কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় চলতি অর্থবছর ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দের বড় একটি অংশ (৮-৯ হাজার কোটি টাকা) চলে যাবে ভ্যাকসিন কেনা বাবদ। বাকি টাকা দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় খরচ করা হতে পারে। এই টাকা ছাড়াও অপ্রত্যাশিত ব্যয় ব্যবস্থাপনা খাতে রয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি ‘অন্যান্য খাত’ নামে আরও এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখা আছে।

প্রথম ঢেউয়ে দেওয়া প্রণোদনার ঋণ এখনো শতভাগ বিতরণ করা হয়নি। তারপরও দ্বিতীয় ঢেউয়ে সরকার নতুন করে কোনো প্রণোদনা ঘোষণা করলে এই খাতগুলোর অর্থ ব্যবহার করা হতে পারে। এছাড়া করোনা দীর্ঘস্থায়ী হবে মনে করেই চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাড়িয়ে বাড়িয়ে বরাদ্দ ধরা হয়েছে। ওএমএস কর্মসূচি চালু রয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ভর্তুকিতে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তা আরও বাড়ানো হবে।