মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অসৎ উদ্দেশ্যে সিনহা হত্যা: তদন্ত প্রতিবেদন

নিজস্ব সংবাদদাতা : অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকা-ের অন্তরালে ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ রয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। পুলিশের অস্ত্র-গুলির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

গতকাল সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

সূত্র জানায় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন সিনহা হত্যাকা-ের পর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নানা পন্থা অবলম্বন করেন। এসপির জবাবদিহিতা এবং তদারকির ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, পুলিশের বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার তদন্ত নিয়ে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তদন্ত নিয়ে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কারণ তদন্তের সময় কিছু ক্ষেত্রে অসাধু কিছু কর্মকর্তা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশি প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সিনহা ও তার তিন সহকর্মীর নির্মাণাধীন ডকুমেন্টারির সঙ্গে হত্যাকা-ের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে করে তদন্ত কমিটি। কক্সবাজারে মাদক নির্মূলে একটি স্বতন্ত্র পন্থারও সুপারিশ করেছে কমিটি। মূল তদন্ত প্রতিবেদনটি ৮০ পৃষ্ঠার। এতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে ১৩টি সুপারিশ রয়েছে। এ ছাড়া মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে ২১ পৃষ্ঠার ছবি ও ৫৮৬ পৃষ্ঠার বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য রয়েছে।

প্রতিবেদন গ্রহণ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনা সরেজমিন তদন্ত করে কারণ, উৎস এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়সহ সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে তদন্ত কমিটিকে সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট এসেছে। রিপোর্টে কী আছে আমরা এখনো দেখিনি। আমাদের সচিব মহোদয় এগুলো বিশ্লেষণ করে যেখানে যেটা প্রয়োজন সেই অনুযায়ী কাজ করবেন।

মন্ত্রী বলেন, আপনারা নিশ্চয় জানেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এটার পুলিশি তদন্ত চলছে। সে কারণে আমরা প্রকাশ্যে কিছু জানাতে পারব না। আমরা আদালতকে এটার সম্পর্কে জানিয়ে দেব, আদালত মনে করলে এটাকে আমাদের কাছ থেকে অফিসিয়ালি নিয়ে যাবেন। আদালত তদন্তের জন্য হয়ত এটা নিয়েও নিয়ে পারেন। এটা আদালতের এখতিয়ার।
তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের নামে অভিযোগ আসবে তাদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা গণমাধ্যমকে জানানো হবে বলেও আশ্বাস দেন মন্ত্রী। সিনহা হত্যার ঘটনাটি পরিকল্পিত ছিল না তাৎক্ষণিক- এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তদন্ত রিপোর্ট আমার কাছে মাত্র এলো। এর ভেতর কী লেখা আছে, কী উল্লেখ আছে আমরা তো জানি না কিছু। আমরা বের করে নেই, আমরা এগুলো স্টাডি করি, তার পর আপনাদের জানাতে পারব।

এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য কী উদ্যোগ নিয়েছেন এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেখুন, দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। আমরা মনে করি এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক। কেন ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে এগুলোর পুরোপুরি বিশ্লেষণ এখানে (প্রতিবেদনে) রয়েছে, সেগুলো আমাদের স্টাডি করতে হবে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করছে, সবাই সজাগ রয়েছে। আমরা মনে করি এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে আমরা সবাই সজাগ রয়েছি।

সিনহা হত্যাকে কেন্দ্র করে দুই বাহিনীর মধ্যে ‘গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে’ এক সাংবাদিকের এমন কথায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দুই বাহিনীর মধ্যে গুজব ছড়িয়ে এদের অসন্তুষ্ট করবে এ ধরনের উপাদান আমরা পাইনি। আমরা মনে করি, চমৎকার একটি পরিবেশ রয়েছে। আমরা দেখেছি পুলিশপ্রধান ও সেনাবাহিনীপ্রধান দুজনে মিলে কক্সবাজারে গেছেন। তারা ব্রিফ করেছেন। কাজেই দুই বাহিনীর ভেতরে মতপার্থক্য রয়েছে এগুলো সত্য নয়।

টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ তার ওপর নির্যাতন করার অভিযোগ করছেন এ রকম একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তার অভিযোগ সঠিক কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভিডিও কোথা থেকে কী হচ্ছে আমরা সেগুলো নজরে আনি না। তথ্যভিত্তিক যেসব সংবাদ আমাদের কাছে আসে, সেগুলোই আমরা নজরে আনি, সেগুলোই আমরা গ্রহণ করি।

কমিটির প্রধান মিজানুর রহমান বলেন, আমি একটি কথা বলব, আমাদের পুলিশ বাহিনী যে আইনশৃঙ্খলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে, এই ঘটনাটি কোনোভাবেই তাদের ভূমিকাকে ম্লান করবে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের ঘটনাটির উৎস, কারণ, প্রতিকার বিষয়ে সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল। আমরা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে আমরা ৬৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।

কমিটিতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম সাজ্জাদ হোসেন এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। চার সদস্যের এই তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেনÑ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি জাকির হোসেন খান এবং কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাহজাহান আলী।

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। এ ঘটনায় ২ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। পরদিন কমিটি ৪ সদস্যের করে পুনর্গঠন করা হয়। সাত কর্মদিবস অর্থাৎ ১০ আগস্টের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বেঁধে দেয় মন্ত্রণালয়। তিন দফা সময় বাড়িয়ে গতকাল প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। সিনহা হত্যাকা-ের ঘটনায় টেকনাফ থানায় দায়ের মামলা র‌্যাব তদন্ত করছে।