বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় বেশি মৃত্যুঝুঁকি ডায়াবেটিক রোগীদের

নিজস্ব সংবাদদাতা : নীরব ঘাতক ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের নারী-পুরুষ এই ঘাতক ব্যাধির শিকার হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্রই প্রায় সমান হারে ডায়াবেটিস ছড়িয়ে পড়ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এ রোগে আক্রান্ত।\হবাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) এক জরিপেও এর প্রমাণ মিলেছে। ওই জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২৫ শতাংশ বা এক-চতুর্থাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনা ডায়াবেটিক রোগীর জন্য আরও ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করা পৃথক গবেষণায় দেখা যায়, করোনায় আক্রান্তের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত ছিলেন। একইসঙ্গে করোনার সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার পর ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী কোনো না কোনো দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। আবার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকে নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া প্রতি তিনজনের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন।\হএ বিষয়ে জানতে চাইলে বাডাস সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত কম থাকে। এ কারণে যে কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার সক্ষমতা শরীরের থাকে না। সুতরাং অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। অনেকের ডায়াবেটিসের পাশাপাশি কিডনি, লিভার, হৃদরোগ, হাইপারটেনশনসহ বিভিন্ন কোমরবিডিটি (বিভিন্ন রোগ) রয়েছে। এসব ব্যক্তির বয়স ষাটোর্ধ্ব হলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত কম থাকবে।\হবাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে করোনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মৃত্যুহার বেশি। বাংলাদেশে করোনায় মোট মৃত্যুর অর্ধেকের বেশির বয়স ষাটের ওপরে। এসব ব্যক্তির ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন কোমরবিডিটি ছিল। সুতরাং এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির করোনা হলে তার মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি।

পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ডায়াবেটিস সেবায় পার্থক্য আনতে পারেন নার্সরাই’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।\হপ্রতিপাদ্যের তাৎপর্য তুলে ধরে বাডাসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, নার্সরা উদ্যোগী হলে ডায়াবেটিস সেবায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারেন। নিজে নিজে রক্ত পরীক্ষা, ইনসুলিন দেওয়াসহ রোগীকে তারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলগুলো শিখিয়ে দিতে পারলে ডায়াবেটিস সেবায় বড় পরিবর্তন আসবে। এজন্য নার্সদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে বলে জানান তিনি।\হচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডির আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ার জার্নালে প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস অ্যান্ড মেটাবলিক সিনড্রোম :ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউস’ শীর্ষক এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ডায়াবেটিক রোগী।\হতাদের মধ্যে পুরুষ এবং ৩১ থেকে ৫০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। করোনা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি হয় ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীর মধ্যে। করোনার সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার পর ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিস আক্রান্তরা কোনো না কোনো দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন।\হকরোনার সংক্রমণের পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য বিশ্বের আরও অনেক দেশে পাওয়া গেছে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের এক প্রবন্ধে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকে নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।

ওই প্রবন্ধে আরও বলা হয়, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য করোনায় আক্রান্ত ৪০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগীর ইনসুলিনের মাত্রা তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। করোনা আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশের জ্বর, ৬০ শতাংশের কফ ও কাশি এবং ৪৫ শতাংশের শরীরে ব্যথা অনুভূত হয়েছে। ৬০ শতাংশের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে ফেরিটিন ও ডি ডাইমারের পরিমাণ অধিক পাওয়া গেছে। ৪ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও কোনো লক্ষণ-উপসর্গ দেখা যায়নি। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন, এমন করোনা আক্রান্তদের মধ্যে উপসর্গহীন বেশি পাওয়া গেছে।\হআন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে করোনা আক্রান্তের মধ্যে ১১ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ২০ শতাংশ, চীনে ১০ শতাংশ রোগীর ডায়াবেটিস রয়েছে। ডায়াবেটিক রোগী করোনায় আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায় বলে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ওই গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীর কভিড-১৯ এ মৃত্যুর আশঙ্কা টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর তুলনায় অনেক বেশি। টাইপ-১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি সাড়ে তিনগুণ বেশি এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ।\হবয়স্ক ডায়াবেটিক রোগী করোনায় আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। যে কোনো টাইপের ডায়াবেটিক রোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি হলে তার মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি। করোনা উপসর্গ নিয়ে যুক্তরাজ্যের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন।\হবাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক বলেন, দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা এক কোটির ওপরে। বয়স্ক অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আবার ডায়াবেটিস বহনকারী ৫০ শতাংশের ওপরে মানুষ জানেন না যে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আক্রান্ত এসব ব্যক্তির একটি বড় অংশের রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ডায়াবেটিসের কারণে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। অর্থাৎ যে কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা হারায়। আবার অনেক ডায়াবেটিক রোগীর কিডনি, লিভার ও হৃদরোগজনিত জটিলতা থাকে। এসব ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুঝুঁকি আছে।\হসার্বিকভাবে বলা যায়, যার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাত্রা যত খারাপ তার ঝুঁকি তত বেশি। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে শর্করা লক্ষ্যমাত্রা তুলনায় বেশি। রক্তে এইচবিএওয়ানসির মাত্রা ৭ শতাংশের বেশি হওয়া মানে অতিরিক্ত ডায়াবেটিস। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিক সতর্ক থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

করোনা মহামারিতে ডায়াবেটিক রোগীর করণীয় :করোনা পরিস্থিতিতে ডায়াবেটিক রোগীর করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার নির্দেশিত কেন্দ্রগুলোতে নমুনা পরীক্ষা এবং পরবর্তী চিকিৎসার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।\হতিনি বলেন, প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন নিতে হবে। খালি পেটে শর্করার মাত্রা ৬ মিলিমোলের কম আর খাবার দুই ঘণ্টা পরে ৮ মিলিমোলের কম মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনে থাকা জরুরি। এই সময়ে পার্ক কিংবা বাইরে হাঁটার প্রয়োজন নেই। শর্করা নিয়ন্ত্রণে বাড়িতে, বারান্দা কিংবা করিডোরে হাঁটাচলার পাশাপাশি হালকা ব্যায়াম প্রয়োজন বলে জানান তিনি।\হকর্মসূচি :দিবসটি উপলক্ষে আজ শনিবার বাডাসের পক্ষ থেকে ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টায় বারডেম হাসপাতালের কার পার্কিং থেকে রমনা পার্ক গেট পর্যন্ত রোড শো কর্মসূচি পালন করা হবে। এছাড়া রমনা পার্কের গেটে এবং এনএইচএন ও বিআইএইচএস’র বিভিন্ন কেন্দ্র-সংলগ্ন স্থানে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় করা হবে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের চতুর্থ তলায় হ্রাসকৃত মূল্যে হার্টের বিভিন্ন পরীক্ষা করানোর সুযোগ পাবেন রোগীরা।