শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে বন্যায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি

আজকের দেশবার্তা রিপোর্টঃ এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় টাঙ্গাইলের প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাকা রাস্তা, সেতু, তাঁতশিল্প ও কৃষি খাতে টাকার অঙ্কে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলা সরকারি দফতরগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

ক্ষতির মধ্যে ৬৪৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা, এক হাজার ৩৫৮ কিলোমিটার রাস্তা এবং ৭৩টি সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রায় পৌনে তিনশ কোটি টাকা, পানিতে নিমজ্জিত হয়ে তাঁতশিল্পে পৌনে তিনশ কোটি টাকা আর ১৩ হাজার ৮৯২ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে ১৪১ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এবারের তৃতীয় দফার বন্যায় টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার মধ্যে ১১টি বন্যা কবলিত হয়। উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল সদর, কালিহাতী, মির্জাপুর, নাগরপুর, বাসাইল, ধনবাড়ী, ঘাটাইল, গোপালপুর, সখীপুর ও দেলদুয়ার। যমুনা, ধলেশ্বরী ও ঝিনাই নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। বর্তমানে নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যার পানি কমলেও অন্য এলাকাগুলোতে পানি আটকে ভোগান্তি বেড়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, জেলার ১ হাজার ৬২৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৬৪৩টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক বিদ্যালয় পানিতে ডুবে গেছে। নিমজ্জিত থাকায় মাটি নরম হয়ে অনেক বিদ্যালয় দেবে গেছে। কোনোটির দেয়াল দেবে গেছে আবার কোনোটির মেঝে ফেঁটে গেছে। বিদ্যালয়ের মাঠগুলোতে পানির স্রোতে ৫-৭ ফুট গভীর গর্তেরও সৃষ্টি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নির্মিত ৬৫টি বিদ্যালয়েরও বেশ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব বিদ্যালয় মেরামত ও নির্মাণ করতে ন্যূনতম সাড়ে ছয় কোটি টাকা খরচ হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ১০১টির জন্য ৩৮ লাখ, ঘাটাইলের ৪১টি বিদ্যালয়ের মেরামতের জন্য প্রায় ২৭ লাখ টাকা, গোপালপুরে ৬৩টির জন্য ৩২ লাখ, বাসাইলে ৫১টির জন্য ৯ লাখ, দেলদুয়ার উপজেলার ৭২টির জন্য ৪৪ লাখ, মির্জাপুরের ৬৮টির জন্য ৪১ লাখ, কালিহাতীর ১০২টির জন্য ১ কোটি ৪০ লাখ, নাগরপুরে ৮৪টির জন্য ৫১ লাখ, ভূঞাপুরের ৪৯টির জন্য ১ কোটি তিন লাখ এবং সখীপুরে সাতটি বিদ্যালয় মেরামতের জন্য ৩৩ লাখ টাকার চাহিদাপত্র প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া নাগরপুর উপজেলার গোবিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাইকশা মাইঝাল পশ্চিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাইকশা মাইঝাল প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি বিদ্যালয় নতুনভাবে নির্মাণের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকার চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ বলেন, এবার বন্যার পানি বেশিদিন অবস্থান করায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ও বিলীন হওয়া বিদ্যালয়গুলো মেরামত ও নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

টাঙ্গাইল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) সূত্রে জানা যায়, এবারের বন্যায় কালিহাতী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ উপজেলার ১৯টি রাস্তার ১১৫ কিলোমিটার ভেঙে ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে। পাঁচটি সেতু ও কালভার্টের ১২৫ মিটার ভেঙে প্রায় ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। দেলদুয়ার উপজেলায় ৭১টি রাস্তার ২৪১ কিলোমিটার ভেঙে প্রায় ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সেতু ও কালভার্টের ৩০২ মিটার অংশ ভেঙে ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার।

এছাড়া টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ৩৮টি রাস্তা ও ৩টি সেতু, ভূঞাপুরে ২৫টি রাস্তা ও দুইটি সেতু, ঘাটাইলে ৩৪টি রাস্তা ও ৫টি সেতু, গোপালপুরে ১০টি রাস্তা ও ৫টি সেতু, ধনবাড়ীতে ২২টি রাস্তা ও ৭টি সেতু, মির্জাপুরে ২৫টি রাস্তা ও ১১টি সেতু, নাগরপুরে ৩৫টি রাস্তা ও ৫টি সেতু এবং সখীপুরে ৮টি রাস্তা ও ১০টি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

টাঙ্গাইল এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম আজম জানান, এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় রাস্তা ও সেতুর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি। এলজিইডির আওতাধীন ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা, সেতু ও কালভার্টের তালিকা করে পুনর্নির্মাণের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। দ্রুত এগুলো নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হবে।

বাতাঁবোর টাঙ্গাইল সদর বেসিক সেন্টার ও বল্লা (কালিহাতী) বেসিক সেন্টার সূত্রে জানা যায়, এ দুটি বেসিক সেন্টারের ৪৯টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও চারটি মাধ্যমিক সমিতির চার হাজার ৩৯১টি তাঁতি পরিবারের ২৭ হাজার ৯৩১টি তাঁত বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা তাঁতশিল্পের তাঁত, কাপড়, তানা ও সরঞ্জামাদীসহ সবকিছু ভাসিয়ে দিয়েছে। পানি জমে থাকায় তাঁতশিল্পের কাঁচামাল বিনষ্ট হচ্ছে।

এ দুটি বেসিক সেন্টারের অধীনে তাঁত ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ থাকায় প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৯ হাজার ৮০০ টাকা করে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক বন্যায় তাঁতশিল্পের প্রায় পৌনে তিনশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

বাতাঁবোর টাঙ্গাইল সদরের বেসিক সেন্টারের লিয়াজো অফিসার মো. রবিউল ইসলাম ও কালিহাতী বেসিক সেন্টারের লিয়াজো অফিসার(ভারপ্রাপ্ত) মো. ইমরানুল হক বলেন, তারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদের মাত্র ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছেন। করোনার সঙ্গে বন্যা যোগ হয়ে তাঁতশিল্পকে ধসের মুখে ফেলেছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারলে তাঁতশিল্প মহাসঙ্কটে পড়বে।

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১৮ হাজার ১২৬ হেক্টর নিমজ্জিত জমির মধ্যে ১৩ হাজার ৮৯২ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে ১ লাখ ৭ হাজার ৩৯১ জন কৃষকের ১৪১ কোটি ২৫ লাখ ৭ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে বোনা আমন ১০ হাজার ৫৮৮ হেক্টর, বোনা আমন বীজতলা ১ হাজার ৩৫৯ হেক্টর, আউশ ১ হাজার ৮০৮ হেক্টর, সবজি ১ হাজার ৪৬৪ হেক্টর, পাট ৭৬৫ হেক্টর, তিল ১ হাজার ৬৫২ হেক্টর, আখ ৬৫ হেক্টর, কলা ৪৫ হেক্টর এবং লেবু ৩৮০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

গত ১১ জুলাই পর্যন্ত বন্যার প্রথম পর্যায়ে ৫ হাজার ৯২৮ হেক্টর নিমজ্জিত জমির মধ্যে ৩ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এতে ২৭ হাজার ২৩৩ জন কৃষকের ৪১ কোটি ৫৫ লাখ ৭ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।

গত ১৩ আগস্ট পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়ের বন্যায় ১২ হাজার ১৯৮ হেক্টর নিমজ্জিত জমির মধ্যে ১০ হাজার ৫১ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে ৮০ হাজার ১৫৮ জন কৃষকের ৯৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাশার জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পর্যায়ক্রমে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত ৪০০ কৃষককে বিনামূল্যে চারা, ৪ হাজার কৃষককে মাস কলাইয়ের বীজ ও সার, ৮ হাজার কৃষককে সবজি বীজ, প্রতি উপজেলার ১৬ জন কৃষককে মেশিনের সাহায্যে বীজ বপন করে দেয়া হবে। একইসঙ্গে কৃষকদের বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে নিয়মিত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।