বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ট্রাম্পের কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না

বিশেষ প্রতিবেদকঃ ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন এখন আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট। করোনাভাইরাস এখনও যায়নি। কিন্তু ট্রাম্প ভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়ে শুধু আমেরিকার মানুষ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এক আমেরিকান কিশোর ট্রাম্পের পরাজয়ের খবর শুনে বলেছে, ‘এই সিনবাদের দৈত্য আমাদের ঘাড়ে আরও চার বছর চেপে বসে থাকবে, এই ভাবনাটা ছিল দুঃসহ। এই দুঃস্বপ্ন থেকে আমরা বেঁচেছি।’

বাইডেনের জয়ে শুধু আমেরিকার উদার ও আধুনিকমনা সাদা নাগরিকরাই খুশি নয়, খুশি বিরাট কালো সম্প্রদায় এবং বহিরাগত অধিবাসীরাও। ফলে দেশটির জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়ে সিভিল ওয়ারের যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা অনেকটা কেটে গেল।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে কালো বারাক ওবামা জয়ী হওয়ায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সারা বিশ্বের মানুষ এক নতুন প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল। এবার ট্রাম্পকে হটিয়ে বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তাবৎ বিশ্বের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।

নির্বাচনজয়ী জো বাইডেনকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকারপ্রধানরা অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটা তার জয়ের স্বীকৃতি। কিন্তু আমি লন্ডনের সাড়ে ছ’টার (শনিবার) সময়েও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কিনা জানি না। এটা কি একটা স্বাভাবিক বিলম্ব, না বরিস জনসন তার ‘মেন্টরের’ পরাজয়ে নিজেও কিছুটা মুহ্যমান হয়ে বাইডেনকে অভিনন্দন জানাতে সময় নিচ্ছেন, তা বলা মুশকিল।

আমেরিকার রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবির্ভাবের পর ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শব্দ দুটি বাদ পড়েছিল। এটা মার্কিন রাজনীতির শতাব্দী-প্রাচীন ট্রাডিশন- জয়ী প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রথম অভিনন্দন জানান পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন সন্তোষজনক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হলেও পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প এখন পর্যন্ত (শনিবার বিকাল) জয়ী বাইডেনের জয়কে স্বীকৃতি দিয়ে অভিনন্দন জানাননি।

হয়তো তিনি পরাজয়ের আঘাত সামলে উঠে পরে বাইডেনকে অভিনন্দন জানাবেন। কিন্তু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ঘর পোড়া গরু যেমন ভয় পায়, তেমনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ দেখে অনেকেই সন্দেহ করছেন, এই মিথ্যাচারী এবং মামলাবাজ রিপাবলিকান নেতা সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত এই নির্বাচন নিয়ে মামলা টেনে না নেয়া পর্যন্ত হয়তো নিস্তর হবেন না।

তিনি যে তার নির্বাচনী প্রচারণায়, ফেসবুকে ও টুইটে অনবরত মিথ্যাচার করেছেন এবং নির্বাচনে কারসাজি হচ্ছে বলে অনবরত মিথ্যা অভিযোগ করেছেন, সে কথা আমেরিকান মিডিয়াই ধরে ফেলেছে এবং প্রকাশ করেছে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখে কোনো লজ্জা নেই। তিনি এখনও বলছেন, তার জয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং নির্বাচনে বিশাল কারচুপি হয়েছে। কারচুপি না হলে তিনি নির্বাচনে জয়ী হতেন।

গত বৃহস্পরিতবার এক সমাবেশে তার বক্তৃতা শুনে মনে হচ্ছিল, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের পরাজয়ের পর দেয়া বেগম খালেদা জিয়ার বক্তৃতা শুনছি। তিনি অনবরত বলছিলেন, আমাদের জয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভয়ানক কারচুপি করেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, তার দলের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এই একই অভিযোগ খালেদা জিয়া করেছিলেন ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে। একটি মার্কিন পত্রিকা প্রশ্ন করেছে, আমেরিকার এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তো কনডাক্ট করেছে ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশনই। তাহলে তার নিজের প্রশাসনই কি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল? ট্রাম্প কি নিজের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনছেন?

এই পরাজয়কে সম্মানের সঙ্গে স্বীকার করার নৈতিকতাবোধ যে ট্রাম্পের নেই, তার প্রমাণ- ভোট গণনার চূড়ান্ত ফল জানার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার এক ফার্ম হাউসে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছেন। তিনি যে পরাজয়ে ভেঙে পড়েছেন, এটা তার প্রমাণ। তার এক কন্যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শান্ত করার। কিন্তু ট্রাম্প কি শান্ত হবেন? মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাস তিনি হোয়াইট হাউসে থাকবেন। তার হাত থেকে জো বাইডেন ক্ষমতা নেবেন ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। এই সময় জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে ঢুকবেন।

এই তিন মাস ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে অবস্থান করবেন এবং তার নির্বাহী কোনো ক্ষমতা না থাকলেও দৈনন্দিন কাজ চালানোর মতো ক্ষমতা থাকবে। ট্রাম্প এই সুযোগের অসদ্ব্যবহার করে আমেরিকায় কোনো সাংবিধানিক সমস্যা সৃষ্টি করেন কিনা, তা নিয়ে অনেকে সন্দেহের দোলায় দুলছেন। ট্রাম্প অত্যন্ত চালাক। তিনি ভবিষ্যতে কী করবেন, নির্বাচন চলাকালীন তার একটি উক্তি থেকে তার আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।’ কেন তিনি নির্বাচনে জয়ী না হলে দেশ ছেড়ে পালানোর কথা বলেছিলেন?

প্রেসিডেন্ট পদে থাকাকালে তিনি এবং তার পরিবারের কোনো কোনো সদস্য এমন সব অনাচার, অন্যায়-দুর্নীতি ও অসাধু ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন এবং জড়িত আছেন, তা এখন অনেকেরই জানা। তিনি নানা মানুষের ওপর অত্যাচার করেছেন, তার ঘনিষ্ঠ জনকে অপমান করে চাকরি থেকে সরিয়েছেন।

তার দুর্নীতি কত ভয়াবহ তার একটা প্রমাণ- তিনি চীনের সঙ্গে দীর্ঘ বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়েছেন। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে গোপনে ডিল করেছেন, যেন চীনের ব্যাংকে তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট রাখা যায়। তার এবং তার কন্যা জামাতার বিরুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সরকারি অর্থ তসরুপ এবং অবৈধ ব্যবসায়ের অভিযোগ রয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশে এবং বিদেশে শত্রু বানিয়েছেন অনেককে। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় কেউ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবতেও পারেননি। দু’একজন বইপুস্তক লিখেছেন। ট্রাম্প নিজস্ব টুইটে তাদের রিডিকুল করেছেন। এখন তিনি আর ক্ষমতায় নেই। তার শত্রুরা এবং তার দ্বারা যারা অপমানিত ও অত্যাচারিত হয়েছেন, তারা দল বাঁধবেন এবং ট্রাম্পের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করবেন। ট্রাম্প এই দিনটির কথাই স্মরণ করে বলেছিলেন, এবারের নির্বাচনে পরাজিত হলে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।

ওয়াশিংটনের যে খবরটি লন্ডনে এসে পৌঁছেছে, তা হল ট্রাম্প নতুন প্রেসিডেন্টকে গোপনে আবেদন জানিয়েছেন, তাকে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমা প্রদর্শন করে সব মামলা-মোকদ্দমা থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা হলে তিনি হোয়াইট হাউস শান্তিপূর্ণভাবে ছেড়ে যাবেন।

এই খবর কতটা সঠিক এবং সঠিক হলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই ধরনের ডিলে যাবেন কিনা তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে।

সারা আমেরিকা এখন উৎসবমুখর। প্রেসিডেন্ট ঘোষিত হওয়ার পর বাইডেন যে ভাষণ দিয়েছেন, তা দেশের প্রগতিশীল সাদা সম্প্রদায়, কালো সম্প্রদায় এবং বহিরাগতদের আনন্দিত করেছে। এরাই একচেটিয়াভাবে বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন এবং বাইডেন অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বহিরাগত অধিবাসীদের সমস্যা মোচনে বিশেষ দৃষ্টি দেবেন। ফলে সারা আমেরিকা এখন উৎসবমুখর। এই আনন্দমুখর জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ট্রাম্প বা তার সমর্থকরা নতুন কোনো ষড়যন্ত্র পাকিয়ে সফল হবেন তা মনে হয় না।

লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকা খবরের হেডিং দিয়েছে end of trump era (ট্রাম্প যুগের শেষ)। ওয়াশিংটনের বাঙালি অধিবাসীরা তাদের মিছিলের প্ল্যাকার্ডে বাংলায় লিখেছেন, ‘তোমার হল শুরু, আমার হল সারা।’

ট্রাম্পের পরাজয়ে আমেরিকার অন্যান্য ইমিগ্রান্ট কমিউনিটির সঙ্গে বাঙালি কমিউনিটি অত্যন্ত আনন্দিত এবং উৎসবমুখর। ট্রাম্পের বহিরাগত নীতির দরুন তারা কম নিষ্পেষিত হননি। তারা এবার দলে দলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন এবং তার জয়লাভে বিশাল আনন্দ শোভাযাত্রা বের করেছেন।

জো বাইডেনের জয়ে শুধু আমেরিকার জনগণ নয়, সারা বিশ্বের জনগণ আনন্দিত হয়েছেন এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। এটা যেন এক দানবের কবল থেকে মুক্তির আনন্দ। ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রনায়করা আশা করছেন, বাইডেনের জয়লাভে বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমিত হবে। চীন ও ইরানের সঙ্গে মৈত্রী না হোক, যুদ্ধাবস্থার অবসান হবে। মধ্যপ্রাচ্যে আবার শান্তি আলোচনা শুরু করার পরিবেশ তৈরি হবে এবং এশিয়ায় মার্কিন নীতির দরুন যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা গরম যুদ্ধে পরিণত হবে না।

মার্কিন এসটাবলিশমেন্ট বহু আগে থেকেই যুদ্ধবাদী। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তাদের অধিকাংশই ছিলেন ট্রাম্পের সমর্থক। এসব বাধার মুখে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার নির্বাচকমণ্ডলীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করতে পারবেন তাতে সন্দেহ আছে।

তার আগে ডেমোক্র্যাট দলীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বর্তমান প্রেসিডেন্টের চেয়ে অনেক বেশি অঙ্গীকার করে এসটাবলিশমেন্টের বাধায় তা পূরণ করতে পারেননি। সুতরাং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকেও বেশি কিছু প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। তবে তিনি এই মুহূর্তে বিশ্বকে উত্তেজনামুক্ত করলেন, দানবমুক্ত করলেন; এজন্য তার জন্য রইল আমাদেরও আন্তরিক অভিনন্দন।