বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাওয়ার গ্রিডে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে কারণ

নিজস্ব সংবাদদাতা : ময়মনসিংহের পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ পিজিসিবির কেওয়াটখালী ১ লাখ ৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) টি-ওয়ান পাওয়ার ট্রান্সফরমারে অগ্নিকাণ্ডের মাত্র দুইদিন আগে মঙ্গলবার (৮ সেপ্টেম্বর) টি-২ এর পাওয়ার ট্রান্সফরমারে শর্ট্ সার্কিট থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। এর আগেও বজ্রপাতে একাধিকবার শর্ট সার্কিট হয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।  

একের পর এক পাওয়ার গ্রিডে অগ্নিকাণ্ডে মানুষের মাঝে আলোচনা ও সমালোচনার  ঝড় বইছে। যদিও বজ্রপাত ও যে কোন শর্ট সার্কিটের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে পাওয়ার গ্রিডের ভেতরে রয়েছে লাইটিং অ্যারেস্টার (এল.এ), সার্কিট ব্রেকার, কারেন্ট ট্রান্সফরমার (সিটি) এবং রিলে সিস্টেম।

অথচ এসব সুরক্ষা থাকার পরও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলেছে। গ্রিডের পাওয়ার ট্রান্সফরমার, লাইটিং অ্যারেস্টর (এল.এ), সার্কিট ব্রেকার, কারেন্ট ট্রান্সফরমার (সিটি) এবং প্যানেল কন্ট্রোলসহ বেশিরভাগ ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করেছে এনার্জিপ্যাক। একের পর এক দুর্ঘটনা এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এনার্জিপ্যাকের এসব ইকুইপমেন্টের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রকৌশলী, টেকনিয়িানসহ সংশ্লিষ্টরা। দাবি করেছেন, পাওয়ার গ্রিডের আধুনিকায়ন এবং মানসম্পন্ন ইকুইপমেন্ট স্থাপনের।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিজিসিবির টেকিনিশিয়ানরা জানান, যে সব পাওয়ার গ্রিড উপকেন্দ্রে জাপান, কুরিয়া, পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এনে পাওয়ার ট্রান্সফরমারসহ অন্য ইকুইপমেন্ট স্থাপন করা হয়েছে, সে সব উপকেন্দ্রে খুব কমই দুর্ঘটনা ঘটছে। আর যে সব উপকেন্দ্রে এনার্জিপ্যাকের ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা হয়েছে সেখানেই একের পর এক শট সার্কিট এবং বজ্রপাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর, নেত্রকোনা, শেরপুর এবং ময়মনসিংহ জেলায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ পিজিসিবির ১৩৩ কেভি উপকেন্দ্র রয়েছে। জামালপুর উপকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানান, উপকেন্দ্রের টি-১,২,৩,৪ এর পাওয়ার ট্রান্সফরমার রয়েছে যার দুটি ৫০/৭৫ এমভিএ (মেগা ভোল্ট এম্পিয়ার) এবং অপর দুটি ২৫/৪১ এমভিএ (মেগা ভোল্ট এম্পিয়ার)। এরমধ্যে ২৫/৪১ এমভিএর একটি কোরিয়ান এবং বাকি ৩টি ট্রান্সফরমার আনা হয়েছে চীন থেকে। এনার্জিপ্যাক থেকে সরবরাহ করা পাওয়ার ট্রান্সফরমারসহ ইকুইপমেন্ট এখন পর্যন্ত বেশি দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে।  

নেত্রকোনা পাওয়ার গ্রিড উপকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম জানান, উপকেন্দ্রের টি-১,২,৩ এর পাওয়ার ট্রান্সফরমার রয়েছে যার দুইটির এমভিএ (মেগা ভোল্ট এম্পিয়ার) ২৫/৪১। এই দুইটির ট্রান্সফরমারসহ অন্য ইকুইপমেন্ট কোরিয়ান। এখনও এই দুই ট্রান্সফরমারে দুর্ঘটনা ঘটেনি।

আগুন নেভানোর কাজ করছে ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা তিনি আরও জানান, অপর পাওয়ার ট্রান্সফরমারের এমভিএ (মেগা ভোল্ট এম্পিয়ার) ৫০/৭৫। এটি ট্রান্সফরমার এবং অন্য ইকুইপমেন্ট এনার্জিপ্যাক থেকে নেওয়া। তিনি যোগদান করার পূর্বে প্রায় ৩ বছর আগে এনার্জিপ্যাক থেকে সরবরাহ করা ট্রান্সফরমার থেকে পল্লী বিদ্যুতে সরবরাহ করার সময় দুর্ঘটনায় আগুন ধরে গিয়েছিল বলে জানান তিনি।

শেরপুর গ্রিড উপকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম সাইদুর রহমান আকন্দ জানান, ২০১৪ সালে স্থাপিত গ্রিড উপকেন্দ্রে টি-১,২,৩ এর পাওয়ার ট্রান্সফরমার রয়েছে যার প্রত্যেকটি এমভিএ (মেগা ভোল্ট এম্পিয়ার) ৫০/৭৫। তিনটি পাওয়ার ট্রান্সফরমার এবং অন্য ইকুইপমেন্ট এনার্জিপ্যাক থেকে নেওয়া।

তিনি জানান, মাত্র ৬ বছরের মধ্যেই এনার্জিপ্যাকের এসব ট্রান্সফরমার বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে, আগুনে পুড়ে গেছে দুইটি কারেন্ট ট্রান্সফরমার(সিটি), ৬টি পিটি (প্রোটেন্সিয়ান ট্রান্সফরমার/ ভোল্টেজ ট্রান্সফরমার) এবং একটি সার্কিট ব্রেকার। পরে এনার্জিপ্যাক থেকে পুড়ে যাওয়া এসব ইকুইপমেন্ট বদলে নতুন দিয়েছে তারা। তবে এনার্জিপ্যাকের ইকুইপম্যান্ট গুনগত মান বিদেশি ইকুইপমেন্টের চেয়ে নিম্নমানের হওয়ায় বারবার দুর্ঘটনায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড বলে ঘটছে দাবি করেছেন তিনি।

এদিকে ময়মনসিংহ পিজিসিবির নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল হক জানান, ৩৩ কেভি উপকেন্দ্রের ৮০/১২০ এমভিএ ক্ষমতা সম্পন্ন ৩টি পাওয়ার ট্রান্সফরমারের ৩টিই সরবরাহ করেছে বাংলাদেশি এনার্জিপ্যাক প্রতিষ্ঠান। ৩টি পাওয়ার ট্রান্সফরমারের মধ্যে পরপর দুইবার আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি আরও জানান, এনার্জিপ্যাকের অনেক ইকুইপমেন্ট আছে। এরমধ্যে কিছুর গুণগত মান নিম্নমানের হলেও অনেক ইকুইপমেন্ট আবার চীনের চেয়েও ভালো। জাপান, পোল্যান্ড, জার্মানির ইকুইপমেন্ট আনতে প্রায় এক মাস সময় লাগে। দাম কম এবং সহজেই পাওয়া যায় বলেই দেশিয় এনার্জিপ্যাক কোম্পানির ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করছে পিজিসিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। 

এ বিষয়ে গ্রাহকদের দুর্ভোগের বিষয়টি স্বীকার করে ময়মনসিংহ কেন্দ্রিয় বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই জানা যাবে বারবার কেন দুর্ঘটনা ঘটছে। পিজিসিবির এনার্জিপ্যাকের ইকুইপমেন্ট সরবরাহ বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিজিসিবির সাবেক প্রকৌশলী জানান, বজ্রপাত মোকাবেলায় স্থাপন করা লাইটিং অ্যারেস্টার উচ্চ মাত্রার বজ্রপাত ঠেকাতে সক্ষম নয় বলেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। এর আগেও ২০০৯ সালে পিজিসিবির ৩৩ কেভি উপকেন্দ্রে ট্রান্সফরমারে আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল।

এনার্জিপ্যাকের ইকুইপমেন্ট নিম্নমানের অস্বীকার করে এনার্জিপ্যাক কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তৌফিকুল ইসলাম জানান, বিদেশি বৈদ্যুতিক ইকুইপমেন্টের দামের তিন ভাগের এক ভাগ দাম দিয়ে এনার্জিপ্যাকের ইকুপমেন্ট কেনা যাচ্ছে। আমাদের ইকুইপমেন্টের পরিমাণও বেশি। বিভিন্ন কারণে ট্রান্সফরমারে দুর্ঘটনা ঘটলেও এনার্জিপ্যাক কোম্পানিকে দোষারোপ করা হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, এনার্জিপ্যাকের ইকুইপমেন্ট দেশে উৎপাদিত এবং কম মূল্যে বিক্রি করা হয়। দুর্ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডের জন্য এনার্জিপ্যাক দায়ী নয় দাবি করেন তিনি।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার গ্রিডের ৩৩ কেভি উপকেন্দ্র থেকে পল্লী বিদ্যুৎকে বিদ্যুৎ সরবরাহের সময় দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় পুড়ে যায় টি-১ এর পাওয়ার ট্রান্সফরমারের সিটি, সার্কিট ব্রেকার এবং প্যানেল ক্যাবল। এর দু’দিন আগে প্রথম দফায় মঙ্গলবার টি-২ এর পাওয়ার ট্রান্সফরমারে আগুন লেগে পুড়ে যায়। এরপর থেকেই বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে ময়মনসিংহ বিভাগের গ্রাহকরা। দুই দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন এবং পিজিসিবির উদ্যোগে কারণ অনুসন্ধানে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। গঠিত কমিটিকে তিন কর্ম দিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

প্রশাসন গঠিত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক জাহাঙ্গীর আলম জানান, আগামী সোমবার তিন কর্ম দিবস শেষ হবে। এর মধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে।