মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বড়লোকের চেয়ে বেশি বেড়েছে গরিবের পথখরচ

আজকের দেশবার্তা রিপোর্টঃ ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ২১৫ টাকা। করোনাকালে অর্ধেক আসন খালি রাখার শর্তে তা বেড়ে হয়েছে ৩৫০ টাকা। বিত্তবানরা বড় কোম্পানির বিলাসবহুল বাসে এ ভাড়ায় স্বচ্ছন্দে চলাচল করলেও স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে গরিব যাত্রীদের। সামর্থ্য না থাকায় সব আসনে যাত্রী তোলা লোকাল বাসেই আড়াইশ’ টাকায় চড়ছেন তারা। এ ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের দ্বিগুণ। বড়লোকের চেয়ে বেশি বেড়েছে গরিবের পথখরচ।

বাসে যখন স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, তখন অর্ধেক আসন খালি রেখে ভাড়া ৬০ ভাগ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, ১১ শর্তে ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ বাসে অর্ধেক আসন খালি রাখাসহ কোনো শর্ত মানা হচ্ছে না। তাই বাড়তি ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করা উচিত।

সরকার বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দূরত্ব ও আসন সংখ্যা অনুযায়ী। এ কারণে একই আসন সংখ্যার ‘মুড়ির টিন’ ও ‘লাক্সারি বাসের’ ভাড়া এক।

গত সোমবার রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে লোকাল বাসের চালক-কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে জানা গেল, ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ৪০ আসনের বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ২১৫ টাকা হলেও যাত্রী পেতে করোনার আগে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা নিতেন। বড় কোম্পানি ২১৫ টাকাই নিত। করোনায় দুই মাস বন্ধ থাকার পর গত ১ জুন থেকে ৩৫০ টাকা ভাড়ায় বাস চালু হলেও এত টাকা দিয়ে চড়ার মতো যাত্রী লোকাল বাসে নেই। আবার অর্ধেক আসন খালি রেখে কম ভাড়ায় বাস চালালে লোকসান।

তাই আগে যেখানে একশ’-দেড়শ’ টাকা নিতেন, এখন যাত্রীপ্রতি দুইশ’-আড়াইশ’ টাকা ভাড়া নেন। যাত্রী যত পান, ততই নেন। অর্ধেক সিট খালি রাখেন না। স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব রক্ষার নাম নেই; অথচ লোকাস বাসে ভাড়া বেড়ে গেছে ১৫০ টাকা। ‘বড়লোক’ যাত্রীর বেড়েছে ১৩৫ টাকা!

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ কে বলেছেন, এ নিয়ে তারা খুব বেকায়দায় আছেন। কিছুতেই বাসে অনিয়ম বন্ধ করতে পারছেন না। বারবার নির্দেশনা দিয়েও কাজ হচ্ছে না। পুলিশও পারছে না। বিআরটিএর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু পাহারা দিয়ে বাসে আসন খালি রাখা সম্ভব নয়। তাই আগের ভাড়ায় ‘যত সিট, তত যাত্রী’ তোলার নিয়ম চালু করাই যুক্তিসংগত।

সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, কিছু কিছু লোকাল বাস অতিরিক্ত যাত্রী নিচ্ছে, ভাড়া বেশি নিচ্ছে- এ অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে ম্যাজিস্ট্রেট-স্বল্পতায় সারাদেশে সমানভাবে অভিযান চালানো যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে অভিযান চালাতে।

করোনার কারণে বাড়ানো ভাড়া প্রত্যাহারের বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত ছাড়া বাসে অর্ধেক আসন খালি রাখার শর্ত তুলে নেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া বাড়তি ভাড়া কমানোও যাবে না।

বিভিন্ন পরিবহনের হয়ে যাত্রী ‘ধরার’ কাজ করা আবুল কালাম জানালেন, ঈদের আগের দু’দিন ঢাকা-নেত্রকোনা পথে প্রতি সিটে ৪৫০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী দিয়েছেন। শনিবার থেকে যাত্রী কমে গেছে। ভাড়াও কমেছে। কোনো যাত্রী যদি পাশের আসন খালি রেখে যেতে চান তবে তার কাছ থেকে দুই সিটের ভাড়া নেওয়া হয়। যাত্রীরা চান কম ভাড়ায় যেতে। সব যাত্রী তুললেও এখন আর কেউ আপত্তি করে না। করোনার ভয় কমে গেছে।

মহাখালী থেকে চলাচলকারী শুধু ‘এনা পরিবহন’ এবং ‘এসইপিএল’ অর্ধেক সিট খালি রেখে সরকার নির্ধারিত ৬০ ভাগ বাড়তি ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে। এনা পরিবহনের ম্যানেজার আতিকুল আলম জানালেন, গত ১ জুন থেকে তারা এ নিয়ম মেনে চলছেন। তাদের বাসের মোট আসনের অর্ধেক অর্থাৎ সর্বোচ্চ ২০ যাত্রী পরিবহন করার সুযোগ রয়েছে। কখনও কখনও ১২-১৩ জন নিয়েও বাস ছাড়তে হচ্ছে।

গতকাল সরকারি ছুটি থাকায় বাস টার্মিনালে যাত্রীর চাপ কম ছিল। তবে বাইরে থেকে ঢাকামুখী যাত্রীর ভিড় ছিল। দুপুর আড়াইটার দিকে সায়েদাবাদে ফেরা কুমিল্লা-ঢাকা রুটের ‘তিশা পরিবহনে’ প্রতিটি আসনই পূর্ণ দেখা যায়। একই রুটের ‘এশিয়া লাইন’ বাসকেও সব আসনে যাত্রীপূর্ণ অবস্থায় ফিরতে দেখা যায়। বাস দুটির অনেক যাত্রীর মুখে ছিল না মাস্ক। তিশা পরিবহনের চালকের সহকারী মো. সিফাত জানালেন, কোরবানির ঈদের দু’দিন আগে থেকেই সব আসনে যাত্রী পরিবহন করছেন। ভাড়া নিচ্ছেন ৩০০ টাকা করে। করোনার আগে নিতেন ২০০ টাকা।

বাসটির যাত্রী আতিকুর রহমান জানান, তাকে কাউন্টার থেকে বলা হয়েছিল প্রতি আসনে একজন যাত্রী বসবে। কিন্তু কুমিল্লার শাসনগাছা থেকে বাস ছাড়ার পর বিশ্বরোডে এসে যাত্রী তোলা হয়। তার পাশের আসনেই বসতে দেওয়া হয়। আপত্তি জানিয়ে লাভ হয়নি।

রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালেও দেখা গেছে অভিন্ন চিত্র। শ্যামলী, টেকনিক্যাল, কলেজ গেটের কাউন্টারগুলো থেকে বাড়তি ভাড়ায় অর্ধেক আসন খালি রেখে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। তবে টার্মিনাল থেকে চলা বাসে করোনা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বাসে ওঠার আগে হাত ধোয়া, যাত্রার আগে-পরে বাসে জীবাণুনাশক ছিটানোর মতো শর্তগুলোও আর মানা হচ্ছে না।

ঢাকা-গাইবান্ধা রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়া প্রায় ৫০০ টাকা। কিন্তু লোকাল বাসগুলো সাধারণ সময়ে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা ভাড়া নিত। করোনার কারণে ভাড়া বেড়ে হয়েছে ৮০০ টাকা। ‘হানিফ’, ‘আলহামরা’, ‘ওরিন’-এর মতো বড় কোম্পানিগুলো অর্ধেক সিট খালি রেখে এ ভাড়াই নিচ্ছে। কিন্তু লোকাল বাসগুলো নিচ্ছে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা। তবে তারা কোনো আসনই ফাঁকা রাখছে না। সব আসনে যাত্রী নিচ্ছে। ভাড়াও বেশি। করোনার পর বন্যায় আক্রান্ত গাইবান্ধার গরিব মানুষের পক্ষে এত ভাড়া আকাশছোঁয়া। কিন্তু যারা জীবিকার প্রয়োজনে যাতায়াত করছেন তাদের বাড়তি ভাড়াই গুনতে হচ্ছে। গতকাল ‘বিসমিল্লাহ পরিবহনে’ ঢাকা ফেরেন গাবতলী এলাকার চা দোকানদার এজাজ আলী। তিনি জানালেন, অনেক দরদাম করে ৫০০ টাকায় এসেছেন। তার পাশের আসনে যাত্রী ছিল। এতে তিনি আপত্তি করেননি।

কারণ, অর্ধেক আসন খালি রেখে চলা বাসে ৮০০ টাকায় চড়ার সামর্থ্য নেই তার। ঈদের আগে ট্রাকে গিয়েছিলেন ৩০০ টাকায়। পথে খুব কষ্ট হয়েছে। তাই ২০০ টাকা বাড়তি খরচ করে এবার বাসে এসেছেন। ঢাকা-গাইবান্ধা রুটে কম ভাড়ায় ট্রেন চললেও টিকিট পাননি এন্তাজ। কারণ সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হয়। অনলাইনে টিকিট কাটার পদ্ধতি জানা নেই তার। নেই স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার। তাই তাকে বাড়তি ভাড়া দিয়ে বাসে আসতে হয়েছে।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, করোনাকালে লাখো মানুষ রোজগার হারিয়েছেন। এমন দুঃসময়ে বাস ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তই ছিল অযৌক্তিক। অর্ধেক আসন খালি রাখার শর্তে ভাড়া বেড়েছিল; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কোনো সিটই খালি নেই। তাহলে বাড়তি ভাড়ার পক্ষে যুক্তি কী?