শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে প্রথম কবিতা ছাপিয়ে ছিলেন ইঞ্জি. আবদুল খালেক

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে মেডিকেল হোস্টেলের সামনে ভাষা শহীদদের গায়েবানা জানাজার পর বিশাল শোক র‌্যালি বের হয়/ছবি: সংগৃহীত
আজকের দেশর্বাতা: ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়। একদিকে রাজপথে বাংলার দামাল ছেলেরা, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু। এই রক্তচক্ষুতে যখন অনেকে তটস্থ, তখন ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখা অমর কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ ছাপানোর মতো দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন এক প্রকাশক-সম্পাদক। তার নাম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। তিনি চট্টগ্রাম থেকে বাংলায় প্রকাশিত জনপ্রিয় দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক।
আবদুল খালেকের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। ওই কবিতা প্রকাশনার দায়ে কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়তে হয় প্রেসের কর্মচারীদেরও। এমনকি প্রেসের ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরীকে কারাভোগও করতে হয় কবিতাটি প্রকাশের কারণে।
ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শীরা পরে এই অবিস্মরণীয় কবিতা প্রকাশের স্মৃতিচারণ করেছিলেন বিভিন্ন লেখায়। সেসব লেখায় জানা যায়, ভাষার দাবিতে তখন সারাদেশ উত্তাল। চট্টগ্রামে গঠিত হয়েছে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। মামুন সিদ্দিকী রচিত ‘ভাষা সংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরী’ বইয়ে লেখা হয়েছে, চট্টগ্রামে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য মাহবুব উল আলম চৌধুরী, চৌধুরী হারুনুর রশীদ, আজিজুর রহমানসহ অনেকে বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন এলাকায় সভা করে তারা যখন অফিসে যান, তখন মাহবুব উল আলমের ১০৪ ডিগ্রি জ্বর এবং গায়ে জলবসন্ত।
অসুস্থতার কারণে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে আসেন সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে ঢাকায় যোগাযোগ করে জানতে পারেন ছাত্রজনতার মিছিলে গুলি চালানো হয়েছে এবং এতে অনেকে মারা গেছেন।
খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের কাছ থেকে এ খবর জানার পর সবাই ফুঁসে ওঠে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে লিখে ফেলেন ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামে কবিতা। সন্ধ্যায় খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং তিনি এই দীর্ঘ কবিতাটি পড়েন। ইলিয়াস তখন বলেন, এটি অসাধারণ একটি কবিতা। এটি ছাপিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারির জনসভায় বিলি করতে হবে এবং আবৃত্তি করে শোনাতে হবে।
শাসকগোষ্ঠীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস থেকে পুস্তিকা আকারে ছাপা হয় ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’, যার মূল্য ছিল দু’আনা।

ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে প্রথম কবিতা ছাপিয়েছিলেন যিনি

২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘী ময়দানে বিকেল ৩টায় শুরু হওয়া সভার এক পর্যায়ে চৌধুরী হারুনুর রশীদ দৃপ্তকণ্ঠে কবিতাটি পাঠ করেন। স্লোগান ও করতালিতে কম্পিত হয় জনসভাস্থল। জনসমুদ্রের বিক্ষোভে প্রকম্পিত হয় বন্দরনগর। ওইদিনই সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে। কবিতা আবৃত্তির অপরাধে ২৪ ফেব্রুয়ারি চৌধুরী হারুনুর রশীদকেও গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। গ্রেফতার করে নিয়ে যায় প্রেসের ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরীকেও।
কোহিনূর প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের ছেলে বর্তমানে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক সেই ঘটনা উল্লেখ করে জাগো নিউজকে বলছিলেন, ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী যে কবিতা লিখেছিলেন, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। সেই কবিতাটা কিন্তু আমার বাবা আমাদের প্রেস থেকে ছেপে দিয়েছিলেন। সেজন্য আমাদের প্রেসটা কয়েকদিন বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। আমাদের ম্যানেজারের জেল হয়ে গিয়েছিল, তিনি আমাদের আত্মীয়। তিনি (প্রশাসনকে) বললেন, আমার সাহেব (আবদুল খালেক) কিছু জানেন না। আমি নিজে ছাপছি এটা। প্রায় ছয় মাস জেল খাটার পর যখন যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলো, তখন তাকে রিলিজ (মুক্ত) করা হলো।
সেই প্রেস ভবনকে (যেখান থেকে দৈনিক আজাদী ছাপা হয়) ভাষা আন্দোলনের স্মারক ঘোষণা করতে নানা সময় দাবি উঠেছে। যদিও এ বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।