শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মৃত্যুদণ্ডকেও ভয় পাচ্ছে না ধর্ষকরা

নিজস্ব সংবাদদাতা : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত হয়েছে গত মাসে। তারপরও গত অক্টোবরেই ২১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকারকর্মী ও নারীনেত্রীরা বলছেন, অপরাধ সংঘটনের পরে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির যদি না দেখা যায় তাহলে এ ধরনের অপরাধীরা ভয় পাবে না।

গত সেপ্টেম্বরে সিলেটের এমসি কলেজে তরুণী ধর্ষণের ঘটনার পর সারা দেশ প্রতিবাদে শামিল হয়। ধর্ষণের মামলায় বিচার ও সাক্ষী সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় আসে। কিন্তু প্রতিবাদ প্রতিরোধের মুখেও ঘটতে থাকে একের পর এক ধর্ষণ।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, অক্টোবর মাসে মোট ৪৩৬ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ৪৪ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণসহ মোট ২১৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ১০১ শিশু ধর্ষণের শিকার এবং ২৫ শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া ১৬ শিশুসহ ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২৩ জনকে। সর্বশেষ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বলছে, মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) ফেনী শহরের বনানীপাড়ায় সেলুনে ১০ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মানিক চন্দ্র দাস নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় শিশুটির মা বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় মামলা করেন।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সামনে আনা না গেলে কেবল আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা যাবে না বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান। তিনি বলেন, ধর্ষক যদি মনে করে অপরাধ করে সে পার পেয়ে যাবে, সমাজে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিতে কোনও প্রভাব পড়বে না, তাহলে সে কেবল আইনের ভয়ে ভীত হবে না। আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। ৯৭ শতাংশ নারী শিশু নির্যাতন মামলার বিচার হয় না, ধর্ষক জামিনে থাকে—এসবই তাদের জন্য গ্রিন সিগন্যালের মতো কাজ করে। ফলে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করলে শাস্তি হবে এবং সেখান থেকে বিনা শাস্তিতে রেহাই পাওয়ার কোনও পথ নেই সেটি যেন ধর্ষক বিশ্বাস করে তেমন পরিস্থিতি তৈরি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

মাত্র শতকরা তিন ভাগ ধর্ষণের মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায় উল্লেখ করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিচালক নিনা গোস্বামী বলেন, এর ওপর আছে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। ১০ বছর ধরে তারা প্রায় তিনশটি ধর্ষণের মামলায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি জানান, এসবের মধ্যে বেশিরভাগ মামলারই বিচার শেষ করা যায়নি। আইনে ছয় মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা বলা আছে। কিন্তু সেটা কাগজে কলমে, এর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। যিনি তদন্ত করছেন, প্রথমত সময় লাগাচ্ছেন। তিনি অনেকবার সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করে আদালতে চার্জশিট দিচ্ছেন। এরপর আছে সাক্ষী হাজিরের বিষয়। ধর্ষণের মেডিক্যাল পরীক্ষা থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তাদেরই বেশ কিছু সাক্ষ্য নিতে হয়, সেগুলোতে লম্বা সময় পর পর একাধিক ডেট পড়তে থাকে। সব মিলিয়ে ততদিনে ভিকটিম পরিবার ক্লান্ত হয়ে যায়। অপরাধ করার পরে বিচার হবে হবে করে যদি দীর্ঘ সময় বিচার না হয় তাহলে অপরাধীর ভয় কেটে যায়। এমনকি যারা এই অপরাধ মানসিকতা লালন করে, তাদের মধ্যেও ‘অপরাধ করেও পার পাওয়ার’ প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে আইন বাস্তবায়ন করা জরুরি।

উল্লেখ্য, গত ১৩ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২০ জারির বিষয়টি জানায়। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, আইনের ধারা ৯ (১) এ উল্লিখিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ করা হয়েছে। এর মানে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর আগে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।