শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রিমান্ডে থেকেও ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মনিরের মামলা

নিজস্ব সংবাদদাতা : মোহাম্মদপুরের ভূমিদস্যু খ্যাত মনিরুজ্জামান মনির পুলিশের রিমান্ডে থেকেই তার অপকর্মের প্রতিবাদকারী ও ভুক্তভোগীদের ৯ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করিয়েছে। পুলিশ হেফাজতে থেকেও দমে যায়নি মনির ও তার অনুসারীরা। অস্ত্র ও মাদক নিয়ে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা যখন তার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন, তখন মনির পুলিশ রিমান্ডে থেকেও নিজের ক্ষমতা প্রভাব খাটাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা যাতে মনিরের দখল থেকে তাদের জায়গা উদ্ধার করতে না পারেন, সেজন্য মনির তার অনুসারীদের দিয়ে ঢাকা উদ্যানে থাকা তার বাগানবাড়ি ও প্লট রক্ষায় বসিয়েছে পাহারা। এমনকি ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও চুরির ‍দুটি মামলা দিয়ে হয়রানি করাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তবে পুলিশ জানিয়েছে, মনিরের বাগানবাড়িতে ভাঙচুরের অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। সেটি পুলিশ তদন্ত করছে। গত ৫ নভেম্বর অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ মনিরুজ্জামান মনিরকে এক সহযোগীসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব-২। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান হাউজিংয়ের অনেক ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। নিজেদের দখল হয়ে যাওয়া জমি ফেরত পেতে তারা আইনের আশ্রয় নেন। ঠিক তখনই ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় আব্দুল হাই নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে চুরি ও ভাঙচুরের মামলা করায় মনির।

ভুক্তভোগী খন্দকার কে এম মোস্তফা নাজিম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘ঢাকা উদ্যানের সি-ব্লকের এক নম্বর সড়কে আমার সোয়া দুই কাঠার একটি প্লট রয়েছে। আমি সেখানে তিনটি দোকান করে ভাড়া দিয়েছিলাম। গত ২০ আগস্ট আমি টিনশেড ভেঙে বহুতল ভবনের কাজ শুরু করি। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ৩০/৪০ জন লোকজন মনিরের নেতৃত্বে এসে আমাদের ঘিরে ফেলে। এসেই সবার মোবাইল নিয়ে যায়। প্লটের ভেতরে আমাদের বসিয়ে রেখে টিন ও বাঁশ দিয়ে তারা বেড়া দিয়ে দেয়। শাকিল আহমেদ নামে একজন জমির মালিক বলে একটি সাইনবোর্ডও টানিয়ে দেয়। দুই ঘণ্টা পর আমাদের মোবাইল ফেরত দিয়ে বলে, ‘প্লটের দিকে তাকাবি না, সোজা সামনে যাবি।’ এরপর আমি থানায় গিয়ে পুলিশকে বলি। কিন্তু থানার ওসি আমাকে বলেন—‘আপনার প্লট তো ওটা না।’ থানা মামলাও নেয় না। আমি ওসিকে জিজ্ঞাসা করলাম—আমার প্লট না, এটা আপনি জানলেন কীভাবে? তারা পরে বললো, তাদের কিছু করার নেই। আমার মামলা নিলো না। এরপর শুনলাম ৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মনির গ্রেফতার হয়েছে। আমি আমার প্লটে গিয়ে ফের দখল নেই। সাইনবোর্ড বসাই, সেটাও মনিরের ক্যাডার বাহিনী রাতে ফেলে দেয়। আমরা জমি কিনে এখন জমির কাছে যেতে পারছি না।’’

তিনি বলেন, ‘প্লটে আমার টিনশেড বাড়ি ছিল, সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ সব আমার নামে, অথচ তারা দখল করে নিলো। পুলিশ আমাদের কোনও সহযোগিতা করলো না। উল্টো মনির পুলিশ রিমান্ডে থেকে মামলা করলো।’

মনির এতই ক্ষমতাবান যে, সে যেদিন গ্রেফতার হয়, ওইদিন ঢাকা উদ্যান হাউজিংয়ের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাদলকে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ফোনে ডেকে নিয়ে থানায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বসিয়ে রাখে। এরপর মনিরকে কোর্ট থেকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে আসার পর তার অনুসারীরা একটি সমবায় অফিস ভাঙচুরের মামলা করে। ওই মামলায় স্থানীয় বাসিন্দা বাদলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রবিবার বাদল জামিনে কারাগার থেকে বের হয়েছেন।

এরকম অসংখ্য ভুক্তভোগী থাকলেও মনিরের ভয়ে কেউ কথা বলতে পারে না। পুলিশের কাছে গিয়ে অনেকেই সহায়তা না পেয়ে চুপ থাকতে বাধ্য হন।

আওয়ামী লীগ কিংবা সহযোগী কোনও সংগঠনের সাধারণ সদস্য পদও ছিল না মনিরুজ্জামান মনিরের। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয় সে। দলের এক নেতাকে টাকা দিয়ে আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ বাগিয়ে নেয়। এরপরই এলাকায় দখল বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে মনির বাহিনী। তার বিরুদ্ধে ট্রাক আটকে চাঁদা দাবি, জমি দখল, হত্যার হুমকিসহ ছয়টি মামলা রয়েছে, যা তদন্তাধীন।

বর্তমানে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের চার দিনের রিমান্ডে আছে মনির। আর রিমান্ডে বসেই সে তার দখল বাণিজ্যের নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে। জানা গেছে, মনির গ্রেফতারের পর ঢাকা উদ্যান আবাসিক এলাকার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হাজি জহির উদ্দিনের ভাই ফজলুল কবির বাদল তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা দিতে গেলে উল্টো বাদলকেই হামলা, ভাঙচুর ও চুরির মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান করা হয়। এই মামলায় আসামি করা হয় মনিরের অপকর্মের প্রতিবাদ করা আরও ৯ জনকে।

এদের একজন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সায়েম শাহিন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দখলদারদের প্রতিবাদ করায় উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মামলার এজাহারে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, ওই সময় আমি আমার বাসায় ছিলাম। এর সিসি ক্যামেরার ফুটেজও আমার কাছে রয়েছে।’

এখানেই শেষ নয়, বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই চুরির মামলায় একজন সাংবাদিককেও আসামি করা হয়েছে। অথচ মামলার এজাহারে ঘটনার যে সময়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সে সময় ওই সাংবাদিক ও তার আরেক সহকর্মী শীর্ষ স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার খ্যাতনামা অনুসন্ধানী সাংবাদিকসহ পেশাগত কাজে মানিকগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। তিনি ৭ নভেম্বর মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরেন।

মনির বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড খালিদ ওরফে কাইল্যা খালিদ ও তার সহযোগী মাসুদ ওরফে ম্যানেজার মাসুদ, ফালান, শুভ, ওলিসহ সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন এলাকার ভুক্তভোগীরা। ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে এ ধরনের মিথ্যা মামলা নিয়ে পুলিশি হয়রানি চললে করোনাকালে পুলিশের ওপর মানুষের যে আস্থা জন্মেছিল, তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনে করেন তারা।

রবিবার (৮ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকা উদ্যানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, তুরাগ নদের তীর ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা দখল করে প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গার ওপরে বাগানবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে। বাগানবাড়ির কিছু জায়গা সরকারি। এ কারণে বিআইডিব্লিউটিএ একবার উচ্ছেদ করলেও ফের সেটি দখলে নিয়েছে ভূমিদস্যু মনিরুজ্জামান মনির। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ—এই বাগানবাড়িকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে মনির। বাগানবাড়ি তৈরি করতে মূলত স্থানীয় জমসু হাজি, কালাচাঁন ও আবু সাঈদ ব্যাপারীর জায়গা অবৈধভাবে দখল করে মনির। সেই দখলি জমিতেই তৈরি করা হয় সুইমিংপুলসহ চোখ ধাঁধানো বাগান বাড়ি।

যদিও ভুক্তভোগীদের অভিযোগের বিষয়ে মনিরের মা সাবিহা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি বিধবা। আমার একমাত্র সন্তান মনির। সে আমেরিকা থাকে। মাঝে মাঝে দেশে আসে। তাকে কিছু লোক ষড়যন্ত্র করে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে।’

মনিরের কাছে অস্ত্র পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর দুটি বৈধ অস্ত্র ছিল। একটি পিস্তল ও একটি স্যুটার গান। এছাড়া আমার ছেলের কাছে আর কোনও অস্ত্র ছিল না। র‌্যাব ভাঙা একটা পিস্তল দিয়ে তাকে গ্রেফতার করছে।’

পুলিশ হেফাজতে থেকেও মনিরের এত ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ জানান, মনিরের বিরুদ্ধে আগের চারটি এবং বর্তমানে দুটি মামলা রয়েছে। আরও মামলা আছে কিনা আমরা খোঁজ করছি। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।

ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়ে ওসি বলেন, ‘যেদিন মনির গ্রেফতার হয়েছে, সেদিন তার সমবায় অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আর শনিবার (৭ নভেম্বর) রাতে মনিরের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হওয়ার ঘটনায় তার মা একটি মামলা করেছেন। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।’