বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে: শিক্ষামন্ত্রী

নিজস্ব সংবাদদাতা : শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, কভিড-১৯ সংক্রমণ বৈশ্বিক সংকট তৈরি করেছে। শিক্ষা খাতও এ সংকটের বাইরে নয়। তাই শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা তাদের ভাবনায় রয়েছে। সবকিছুই নির্ভর করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলে দেওয়া সম্ভব হবে, তার ওপর।

তিনি বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেমে নেই। তাদের মূল্যায়ন করে পরবর্তী শ্রেণিতে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। অক্টোবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হলে কী হবে, নভেম্বরে খোলা গেলে কী হবে- সবকিছুই পরিকল্পনার মধ্যে আছে। তবে ডিসেম্বরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হলে আগামী শিক্ষাবর্ষের দু-এক মাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করা, সিলেবাস কমিয়ে আনা, কারিকুলাম ম্যাপিং- সবকিছুই তাদের ভাবনায় রয়েছে।

এ সময় তিনি করোনাকালে শিক্ষার ক্ষতি ও করোনা-পরবর্তী সময়ে সরকারের পরিকল্পনার বিশদ তুলে ধরেন। দীপু মনি বলেন, করোনার সংকট শুধুই সমস্যা নয়, নতুন সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে দক্ষ হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষায় বাড়ছে। সরকার এখন শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

দেশের প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রীর গৌরব অর্জন করা ডা. দীপু মনি বলেন, মার্চ থেকেই সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদান চালু করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক পাঠদান ব্যাহত হওয়ায় এই উদ্যোগ। করোনার কারণে সবকিছু শতভাগ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয়। অস্বাভাবিক এ পরিবেশে যতটা স্বাভাবিক রাখা যায়, আমরা তার চেষ্টা করছি। বর্তমানে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায়ও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ আগেই তা শুরু করেছে। সংসদ টেলিভিশনের ক্লাসের মান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রথম দিকের ক্লাসগুলোর মান ভালো ছিল না। শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল, তাদের প্রশিক্ষণ ছিল না। ক্লাসের মান ভালো না হলে পুরো সময় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা যায় না। আগস্ট থেকে টেলিভিশন ক্লাসের মান উন্নত হয়েছে। এটুআই ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা আমরা নিয়েছি। কম্পিউটার অ্যানিমেশন ব্যবহার করে ক্লাসগুলো আকর্ষণীয় করা হয়েছে। এখন আমাদের টার্গেট শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছে এই পাঠদান নিয়ে যাওয়া।

কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠা খুলে দেওয়া হতে পারে- জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখনও জানি না করোনার প্রকোপ আগামী দিনগুলোতে কেমন হবে। জানি না কতদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। সময়ই বলে দেবে আমাদের কী করতে হবে।’

চলতি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও মূল্যায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, সিলেবাস নূ্যনতম কতটুকু কমিয়ে কাম্য দক্ষতা অর্জন করিয়ে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন দেওয়া যাবে, তা নিয়ে কাজ হচ্ছে। কেউ কেউ অটো প্রমোশনের কথাও বলছেন। যদি আমরা চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রতিষ্ঠান খুলে এক মাসও ক্লাস নিতে পারি, তাহলেও শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ক্লাসে যেতে সমস্যা হবে না। আমরা এমনও ভেবেছি, যদি এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যেও স্কুল-কলেজ খোলা সম্ভব না হয়, তাহলে প্রয়োজনে আগামী বছরের দু-এক মাস সময় নিয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ করা হবে। এতেও জটিলতা আছে। এটি করা হলে কোনো কোনো ক্লাসে কোনো সমস্যা নেই, আবার কোনো কোনো ক্লাসে সমস্যা আছে। যেমন নবম-দশম শ্রেণিতে সমস্যা হবে।

ডা. দীপু মনি বলেন, করোনার মধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়ার বড় ঝুঁকি আছে। কেউ কেউ বলছেন, ঘরে আটকে থাকা শিশুরা যে ক্লাসে যেতে পারছে না, এতে ঝুঁকি আরও বেশি। বিশ্বের নানা দেশের পরিস্থিতি আমরা নজর রাখছি। অনেক দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে আবার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা গায়ে গায়ে লেগে বসে। তারা করোনা সংক্রমিত হলে তাদের পরিবারের সদস্যরা বিশেষত বয়োজ্যেষ্ঠরা ঝুঁকিতে পড়বেন। তাই এসব বিষয়ে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের করোনাবিষয়ক জাতীয় কমিটির সঙ্গেও আমরা এ নিয়ে সভা করেছি। বিষয়টি অনেক বড় দায়-দায়িত্বের ব্যাপার। তাই সিদ্ধান্তও হবে দায়িত্ব নিয়েই।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কবে :চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা কবে নেওয়া হতে পারে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এ বছরের এইচএসসি-সমমান পরীক্ষার্থী প্রায় ১৪ লাখ। পরীক্ষার আয়োজন করতে হলে পরীক্ষার্থী, শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্টাফ, শিক্ষা বোর্ড- সব মিলিয়ে আমরা হিসাব করে দেখেছি প্রায় ২৫ লাখ লোকের সমাগম হবে প্রতিদিন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গণপরিবহন ব্যবহার করবেন। এই বিপুল জনসমাগম করোনার সংক্রমণ বাড়িতে দিতে পারে। আমরা পরীক্ষার কেন্দ্রসংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারি, ফাঁকা ফাঁকা করে পরীক্ষার্থীদের বসাতে পারি। কিন্তু তারা তো গণপরিবহনে সেই ঠাসাঠাসি করেই আসবে। একজন পরীক্ষার্থীও যদি সংক্রমিত হয়, তার শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ মুহূর্তে পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। এটা সত্য। আবার এটাও সত্য, এ পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হতে হয়।

তিনি বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এইচএসসি পরীক্ষা, ফল প্রকাশ, ভর্তি পরীক্ষা সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হতে হতে মার্চ মাস গড়িয়ে যায়। আমরা যদি এবারের এইচএসসি পরীক্ষা ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে নিতে পারি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মার্চেই ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে। আর যদি শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রয়োজনে এ পরীক্ষা আরও দুই মাস পিছিয়ে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিও দুই মাস পিছিয়ে শুরু হয়, তাহলেও যারা দেশে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হবে, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। উপাচার্যদের সঙ্গেও এটা নিয়ে কথা বলেছি। তারাও সম্মত আছেন। সমস্যা হলো, যারা বিদেশে পড়তে যাবে তাদের নিয়ে। করোনার এই বৈশ্বিক সংকটে সবার সব সমস্যা আমরা একসঙ্গে সমাধান করতে পারব না। তবে এসব সমস্যার সমাধানে আমরা অনেক কিছুই ভাবছি। সবকিছুই আমাদের ভাবনায় আছে। সবকিছুই নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর।

পরিমার্জন হবে শিক্ষানীতি :জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ পরিমার্জন করা হবে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে ১০ বছর হলো। বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ে ১০ বছর অনেক লম্বা সময়। করোনা সংকটকালে অনলাইন শিক্ষার গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করেছি। শিক্ষানীতিতে তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার, সম্ভাবনা, নতুন জ্ঞান, আধুনিক কারিকুলাম সবকিছু এতে থাকবে। বারবার শিক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই একটি বড় ডিগ্রিকে ভেঙে ছোট ছোট মডিউলে ভাগ করতে হবে। মডিউলার শিক্ষার দিকে আমাদের এগোতে হবে। 

মন্ত্রী বলেন, আশা করছি দু-তিন মাসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিটি গঠন করে আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করে দেব।

এমপিওতে শহরে ও গ্রামে ভিন্ন পাসের হার : বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির নীতিমালা ও জনবল কাঠামো-২০১৮ সংশোধন করা হচ্ছে জানিয়ে ডা. দীপু মনি বলেন, বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। আর একটি সভা করলেই তা চূড়ান্ত করা যাবে। এমপিও নীতিমালায় নানা অসংগতি ছিল, আমরা তা দূর করেছি। যেমন, আগে শহর ও গ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য শর্ত হিসেবে পাসের হার একই চাওয়া হতো। এটি তো বৈষম্য। এবার শহর ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাসের হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জন সহজ হবে। নীতিমালা চূড়ান্ত হলেই এমপিওভুক্তির আবেদন চাওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

করোনা এনেছে নতুন সম্ভাবনাও :সংকটের মধ্যেও করোনা নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে জানিয়ে দীপু মনি বলেন, শিক্ষা খাতে আগামী চার-পাঁচ বছর পর যা করতে হতো, তা এখনই শুরু করা গেছে। অনলাইন শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। শিশু শিক্ষার্থীরা তাদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার নানা চমক ভার্চুয়াল জগতে দেখাচ্ছে। তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হচ্ছে। অনলাইনে তারা নানাকিছু তৈরি করছে। করোনার ছুটিতে কর্মজীবী বাবা-মাকে এবারই প্রথম দীর্ঘ সময় সন্তানেরা কাছে পেয়েছে। পারিবারিক বন্ধনগুলোকে সুদৃঢ় করা গেছে। তাই পুরোটা সময় নষ্ট হয়েছে- এমন নয়। ইতিবাচক কাজেও লাগানো গেছে।

এ অবস্থার আলোকে করোনা-পরবর্তী কারিকুলাম নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে। পাঠ্যবই পরিবর্তন, পরিমার্জন করে আরও আকর্ষণীয় করা হবে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে গুণগত শিক্ষার মান উন্নয়নে।