শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংকটে ৯ ব্যাংক

নিজস্ব সংবাদদাতা : বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় অধিকাংশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে এলেও সংকট বেড়েছে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোতে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে চতুর্থ প্রজন্মের নয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বোঝা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। চলতি বছরের জুন শেষে নয়টি ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি বেড়েছে সাতটির, কমেছে মাত্র দুটির।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে নয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৪৭৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২২৪ কোটি দুই লাখ টাকা। আর বছর ব্যবধানে বেড়েছে ৪৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক নির্দেশনার পরও শৃঙ্খলার মধ্যে আসেনি তারা। ফলে হুমকিতে পড়েছে এসব ব্যাংক, ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে আর্থিক খাত। রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব ব্যাংককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণেই নিয়ম মানার কোনো তোয়াক্কা করছে না তারা। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছর (২০১৯-২০) শেষে নয় ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৪৭৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। মাত্র ছয় মাস আগে এই খেলাপির পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২৪ কোটি টাকা।

২০১৯ সালের জুনে এই নয় ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ২৮ কোটি ২২ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দেয়ার পর তারা নতুন কিছু করতে পারেনি। পরিবারকেন্দ্রিক চলছে। শুরু থেকেই বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। তারা নতুন কোনো পণ্য আনেনি। পুরনো গ্রাহকদের পেছনেই ঘুরছে। পুরনো ব্যাংকের নীতিতে চলছে। ফলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিলেও তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। আর নতুন কিছু করতে না পারলে যত সুযোগই দেয়া হোক না কেন, তাদের উন্নতি হবে না। তাই ব্যাংকগুলোকে একটি নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার সময় নতুন নতুন পণ্য ও সেবা আনার শর্ত জুড়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নতুন প্রজন্মের নয় ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষ খেলাপির তালিকায় আছে পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭০৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল তিন হাজার ৯৮৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। দ্বিতীয় নম্বরে রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৪৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তবে ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ২৫৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩০৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ২৪৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

মেঘনা ব্যাংকের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৪৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল ২৪৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১২৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১৪৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

এনআরবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৪৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, আগের বছর যা ছিল ৯৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। মধুমতি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ চলতি বছরের জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ৮৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা, গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৭৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। মিডল্যান্ড ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৫৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় গত মার্চে। তারপর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। এ সংকটকালে ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেয় সরকার; আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে না।

এর আগে করোনার কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ শ্রেণিকরণে স্থগিতাদেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মহামারির প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ায় আরও তিন মাস বর্ধিত করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। অর্থাৎ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো ঋণের শ্রেণিমান পরিবর্তন করা যাবে না। যে ঋণ যে শ্রেণিতে আছে, সে অবস্থাতেই থাকবে। তারপরও বেড়েছে খেলাপি। সমাপ্ত অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) প্রায় তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। যা মোট বিতরণ ঋণের ৯ দশমিক ০৩ শতাংশ। জুন শেষে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকায়।

এর আগে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে সরকারের নির্দেশনায় পুনঃতফসিলে গণছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পান ঋণখেলাপিরা। ২০১৯ সালের ১৬ মে নীতিমালায় এ ছাড় দেয়ার পর থেকে বিশেষ বিবেচনাসহ গেল বছর পুনঃতফসিল হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণের। এত সব সুবিধা নেয়ার পরও কমছে না খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পুরো ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।