শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আদায় চলছেই

নিজস্ব সংবাদদাতা : করোনা মহামারিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়িদের কথা চিন্তা করে ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আদায়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্ত্বেও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নানাভাবে হয়রানি ও জোর-জবরদস্তি করে কিস্তি আদায়ের অভিযোগ উঠেছে ক্ষুদ্রঋণ বিতরনকারি বিভিন্ন এনজিও’র বিরুদ্ধে।

তাদের মাঠকর্মীরা দলবল নিয়ে ঋণগ্রহীতাদের বাড়ি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদেরকে নানাভাবে হুমকি প্রদর্শনের মাধ্যমে কিস্তি আদায়ে বাধ্য করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এনজিও কর্মীদের বিরতিহীন নানাবিধ চাপে রীতিমত দিশেহারা হয়ে পড়েছেন গ্রামীণ জনপদে বাস করা নিম্নআয়ের সাধারণ দিনমুজুর ও খেঁটেখাওয়া কর্মহীন মানুষ।

এনজিও মাঠকর্মীদের আতঙ্কে অনেকে তাদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু তাদের অনেকেই ভবিষ্যতে আর কোন ঋণ না পাওয়ার ভয়ে এদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ বা মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোন সুফল মিলছে না।

সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জোরপূর্বক কিস্তি আদায় করলে লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করেও কিস্তি আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এনজিও কর্মীরা। এরই মধ্যে চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন স্থানে কিস্তির টাকা আদায় নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে এনজিও কর্মীদের উগ্র আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদের ঘটনাও ঘটেছে।

এনজিওগুলো থেকে সাধারণত যারা ঋণ নিয়ে থাকেন তাদের সিংহভাগই গ্রামের সাধারণ কৃষক, রিকশা-ভ্যান-সিএনজি চালক, চায়ের দোকানদার, সবজি বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, প্রবাসী ও দিনমজুরের মতো নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনের আয় বা মাসিক বেতন থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে তারা তাদের সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তি পরিশোধ করেন।

বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতা অভিযোগ করেন, এনজিও’র মাঠ কর্মীরা লোকজন নিয়ে বাড়িতে এসে তাদের কিস্তি পরিশোধের জন্য জন্য চাপ দিচ্ছে, করোনার এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ঘন্টার পর ঘন্টা বাড়িতে বসে থেকে মানসিকভাবে নির্যাতন করছে, অফিস থেকেও বড় বড় কর্তারা ফোন দিয়ে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।

বেশ কয়েকটি এনজিও’র মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মী বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি কিস্তি পরিশোধ করার মতো অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। কিন্তু কিস্তি আদায় করতে না পারলে আমাদের বেতন আটকে রাখা হয়। এমনকি চাকরিও চলে যায়। তাই কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমরা মাঠে নামতে বাধ্য হই।’

এনজিও কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোক জমায়েত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারিকৃত স্বাস্থ্যবিধির কোনরূপ তোয়াক্কা না করে যেভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা মহিলাদের জমায়েত করছেন, তাতে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনা সংক্রমনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও অনেকাংশে বেড়ে যাচ্ছে।

তারা জানান, গত ৬ মাস ধরে আমাদের আয়-রোজগারের সব পথই বন্ধ। নানারকম সরকারি-বেসরকারি ত্রাণের ওপর বেঁচে আছেন। এ অবস্থায় তাঁদের কোনভাবেই কিস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। কিস্তির তাগাদার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হচ্ছে বলেও জানান তারা।

‘ব্যুরো বাংলাদেশ’ নামক একটি এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণকারী নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী সদস্য অভিযোগ করে বলেন, অসুস্থ থাকার কারণে আমি গত রোববার (৩০ আগস্ট) সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে পারি নাই। কিন্তু তাদের একজন পুরুষ মাঠকর্মী সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত আমার ঘরে বসে ছিলেন। এসময়ে ওই মাঠকর্মী আমাকে নানান কটুকথা বলে মানসিকভাবে হয়রানি করে কিস্তি দেয়ার জন্য। পরে আমি বাধ্য হয়ে তাতক্ষনিক আমার কয়েকটি হাঁস-মুরগি বিক্রি করে কিস্তি পরিশোধ করি।

তাছলিমা নামে একজন গ্রাহক অভিযোগ করে বলেন, দৈনিক রোজগার বন্ধ, পরিবারের দৈনন্দিন খাবারের চাহিদা মেটাতেই যেখানে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে কিস্তির চাপ আর নিতে পারছি না। এনজিও কর্মীদের সরকারি নির্দেশনা কথা স্বরণ করিয়ে দিলে তারা ধমকের স্বরে বলেন, ‘আপনাদেরকে কি সরকার লোন দিয়েছে? সরকারের কথা বলছেন কেন? আমরা সরকারকে চিনিনা, লোন দিয়েছি আমরা, আমাদের কথাই আপনাদেরকে শুনতে হবে।’

সাথী নামে অন্য একজন গ্রাহক বলেন, ‘রাত পোহালেই কিস্তির জন্য এনজিও কর্মীরা বাড়িতে চলে আসছেন। যতক্ষণ টাকা পরিশোধ না করা হয় ততোক্ষণ এনজিও কর্মীরা বাড়ী থেকে যেতে চান না এবং পরবর্তীতে ঋণ দেয়া হবে না বলে হুমকি দিচ্ছেন।’

প্রায় একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে এসএসএস, ব্র্যাক, টিএমএসএস, আশা, শক্তি, সুরা, জাগরণী, কনফিডেন্স, আশার আলো সহ ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী আরো কয়েকটি এনজিও’র বিরুদ্ধে।

যোগাযোগ করা হলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর বলেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিস্তি আদায়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া আছে, কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে ঐ এনজিও’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এবিষয়ে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, জোর করে কিস্তি আদায় করছে এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রসঙ্গত, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি’র (এমআরএ) এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সারাদেশে করোনা সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোন গ্রাহককে কিস্তি পরিশোধে চাপ প্রয়োগ করা যাবেনা, তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিস্তি পরিশোধ করতে চান তাহলে তা গ্রহণ করা যাবে। কোন গ্রাহক যদি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে তাদের ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলেও ঋণকে নিয়মিত রেখে প্রয়োজনে নতুন ঋণ দিতে হবে।