শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সারা দেশে বিস্তৃত ‘প্রতারণার জাল’

নিজস্ব সংবাদদাতা : মো. হাসান অষ্টম শ্রেণি পাস। প্রযুক্তির সহায়তায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার তরুণীদের সঙ্গে গড়ে তোলে নিবিড় সম্পর্ক। নিজেকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কর্মকর্তা পরিচয় দিয়েম্প এ সর্ককে আরও গভীরে নিয়ে যায়।

হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমু এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারে আবেগাপ্লুত অবস্থায় কথা বলে ভিডিও কলে। আপত্তিকর ছবি, ভিডিও এবং কথোপকথন রেকর্ড করে রাখে। পরে ওইসব রেকর্ড দিয়ে শুরু হয় তার ‘ব্ল্যাকমেইলিং’। এভাবে হাসান ১০-১২ জন তরুণীর কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে আদায় করেছে মোটা অঙ্কের অর্থ। ৩০ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

হাসানের এমন প্রতারণার বর্ণনা কাছে তুলে ধরলেন ডিএমপির শ্যামপুর থানার ওসি মফিজুল আলম। শুধু হাসানই নয়, এমন অসংখ্য প্রতারকের ফাঁদে আটকা পড়ছেন সাধারণ ও নিরীহসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই। ঘরেবাইরে সব জায়গায় প্রতারণার ফাঁদ। অভিনব কৌশলে প্রতারণার জাল বিস্তৃত হচ্ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। পুরনো কৌশলকে পাশ কাটিয়ে নতুন কৌশলে চলছে এ প্রতারণা। আর সময়ে সময়ে প্রতারকরা কৌশল পরিবর্তন করায় তাদের ধরতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারে (সিপিসি) প্রতিদিন গড়ে প্রতারণার এক হাজার ২০০ অভিযোগ আসছে। তবে এই পরিসংখ্যান প্রতারণার প্রকৃত তথ্য নয়। বাস্তবে আরও অনেক বেশি ঘটনা ঘটছে। এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর হাতে গত ১১ মাসে গ্রেফতার হয়েছে ৪ শতাধিক প্রতারক। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই মুহূর্তে দেশে আর্থিক প্রতারণা বেশি হচ্ছে। ই-কমার্স এবং অনলাইনে পণ্য বেচাকেনায় প্রতারণার শেষ নেই। অনলাইনভিত্তিক এমএলএম কোম্পানির নামে হচ্ছে প্রতারণা। অনলাইনে পণ্য কেনাবেচা, বিকাশ কর্মকর্তা পরিচয় এবং চাকরি দেয়ার নামেও অনেক প্রতারণা হচ্ছে। পর্নোগ্রাফি, হুমকি, ব্ল্যাকমেইলিং, ফেক ফেসবুক আইডি তৈরি করে প্রতারণা চলছে অহরহ।

ধর্ষণ বা শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে প্রতারণা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ও মানবাধিকার সংগঠনের নামে চলছে প্রতারণা। সাংবাদিক পরিচয়েও প্রতারণা করছে এক শ্রেণির প্রতারক। প্রতারণার ক্ষেত্রে সুন্দরী নারী বা নারীকণ্ঠও ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ভুয়া পদক-পুরস্কার ও জাল সার্টিফিকেট। অনুদান বা করোনায় সহায়তার নামে প্রতারণায় নেমেছে বেশ কয়েকটি চক্র।

ফেসবুকে বন্ধু সেজে বিদেশ থেকে উপহার পাঠানোর নামে অনেকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে সর্বস্ব। বর সেজে কন্যা বা কন্যার পরিবারের সদস্যদের করা হচ্ছে নিঃস্ব। নবাব পরিবারের সদস্য সেজে এক প্রতারক হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। বিদেশে লোক নিয়োগের নামে প্রতারণা চলছে অহরহ। ভুয়া করোনা সনদ দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে। টার্গেট করে বিত্তবানদের অভিজাত ফ্ল্যাটে নিয়ে নারী দিয়ে ফাঁসাচ্ছে কোনো কোনো প্রতারক। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলে সেই ছবি ব্যবহার করে প্রতারণায় নেমেছে বহু প্রতারক।

এ ছাড়া মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, কাস্টমস কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা, দুদক কর্মকর্তা ও জমির মালিক পরিচয়ে চলছে প্রতারণা। দামি গাড়ি, আলিশান অফিস এবং পোশাকের চাকচিক্য দেখিয়ে প্রতারণা করছে অনেকে। তাছাড়া উপবৃত্তির টাকা নিশ্চিতের প্রলোভন, জমির মালিক বা ক্রেতা সেজে এবং টার্গেট করা ব্যক্তির ছবি বা কথোপকথন রেকর্ড করাসহ প্রতারণার জন্য নানা অভিনব পন্থা বের করছে প্রতারকরা।

এ বিষয়ে সিপিসির অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, প্রতারণার যেসব ঘটনায় অভিযোগ দেয়া হচ্ছে বা মামলা করা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে শুধু সেসব ঘটনার পরিসংখ্যান আছে। বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই অভিযোগ করছেন না। অভিযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ সঠিক জায়গাও খুঁজে পাচ্ছে না। একটি অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তে গিয়ে জানা যায়, ওই ঘটনায় বিপুলসংখ্যক লোক প্রতারিত হয়েছেন। কিন্তু তারা অভিযোগ করেননি।

এ কারণে প্রতরণার সংখ্যা বা প্রতারিত হওয়ার ব্যক্তির সঠিক পরিসংখ্যান নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। তিনি বলেন, যারা অভিযোগ করছেন তাদের বেশিরভাগই স্ক্রিনশট নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। শুধু স্ক্রিনশটের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত হলে এর সফলতা আসে না। স্ক্রিনশট এক ধরনের ছবি। এটা দিয়ে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। তাই অভিযোগের সঙ্গে ইউনিফর্ম রিসোর্স লোকেটর (ইউআরএল) বা ওয়েব ঠিকানা এবং নিউমেরিক আইডি দিতে হবে।

র‌্যাবের সহকারী পরিচালক ইমরান খান বলেন, জঙ্গিবাদ, খুন, ধর্ষণ, নাশকতা এবং অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি প্রতারণার বিষয়ে র‌্যাব অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে চাকরির প্রলোভন, সেনা-নৌ-বিমান-পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি সংস্থায় চাকরির প্রলোভন, রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের মালিক সেজে প্রতারণা এবং কথিত প্রতিষ্ঠানের নামে দেশব্যাপী ডিলার নিয়োগে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে গত ১১ মাসে র‌্যাব ৪৫৮ প্রতারককে গ্রেফতার করেছে।

তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে এনজিও ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের অফিস সাজিয়ে কয়েক কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে ১২ নভেম্বর প্রতারক চক্রের সদস্য সাইদুজ্জামান নুর ওরফে রাকিবকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। সুসজ্জিত অফিস কক্ষে রাকিব তার নিজের ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্জিত বঙ্গবন্ধু পদক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পদক, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পদক, মাদার তেরেসা পদক ও মহাত্মা গান্ধী শান্তি পদকসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার ভুয়া স্মারক ও জাল সার্টিফিকেট সাজিয়ে রেখে লোকজনকে আকৃষ্ট করত।

করোনা পরীক্ষায় প্রতারণার মামলায় বহুল আলোচিত বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদকে গত ১৫ জুলাই গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর আগে গত ৬ জুলাই র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর কার্যালয়ে অভিযান চালান। এরপর একে একে বেরিয়ে আসে সাহেদ ও তার সহযোগীদের প্রতারণার নানা কাহিনী।

এ ছাড়া করোনাভাইরাসের ভুয়া সনদ বিক্রির অভিযোগে জে কে জি হেলথ কেয়ারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের এরইমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি কয়েক দফায় বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিকসহ অর্ধশতাধিক প্রতারককে গ্রেফতার করে সিআইডি। তারা ফেসবুকে ফেক আইডির মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে।

এরপর দামি গিফট পাঠানোর নাম করে কাস্টমস থেকে তা ছাড়িয়ে নিতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এক প্রতারক গোলাম মোস্তফার বর্ণনা দিতে গিয়ে পুলিশ জানায়, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা কামানোই গোলাম মোস্তফার কাজ। ঘটকের সঙ্গে হবু বর সেজে মোস্তফা নিজেই যায় কনে দেখতে। এক দেখাতেই পছন্দ। বরের ভাই শান্তি মিশনে আফ্রিকার কোনো একটা দেশে আছেন। ফিরলেই বিয়ে। বিয়ের কথা পাকাপাকি হওয়ার পর নানা কৌশলে কনে ও কনের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় মোস্তফা। এ পর্যন্ত ১২টি পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সে।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের সাবেক এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে চলছিল নতুন প্রতারণা। ই-কমার্সের নামে ডিজিটাল ফরম্যাটে এমএলএম ব্যবসা করে গত দশ মাসে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ২৬৮ কোটি টাকা।

নবাব সলিমুল্লার পরিবারের সদস্য পরিচয়ে প্রতারণা চালাচ্ছিল ভুয়া নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী। তার প্রকৃত নাম কামরুল ইসলাম হৃদয়। গত ২ নভেম্বর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করেন।

সিটিটিসির উপকমিশনার মাহফুজুল ইসলাম জানান, এই ভুয়া নবাব টার্গেট করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকানা রয়েছে-এমন প্রচারণা চালিয়ে কামরুল সেখানে চাকরি দেয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, এক শ্রেণির প্রতারক বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথের সামনে দামি গাড়ি আর কেতাদুরস্ত পোশাক পরিধান করে মোবাইল ফোনে কথা বলতে থাকে। তারা এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলা ব্যক্তিদের টার্গেট করে। খুব সুন্দর করে মিষ্টি ভাষায় কোনো নারী গাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে বলেন: ভাইয়া, অমুক ঠিকানাটা কোথায়?

টার্গেট করা ব্যক্তি কাছে যাওয়া মাত্রই জোর করে গাড়িতে তুলে কালো কাচের দরজা লাগিয়ে দেয় প্রতারক চক্রের সদস্যরা। পরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার কাছে থাকা ডেভিট, ক্রেডিট, মাস্টার বা ভিসা কার্ডের গোপন পিন নম্বর জেনে বিভিন্ন বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েকদিন আটকে রেখে ব্যাংকে থাকা সব টাকা তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে।

নানা অপকর্মে অভিযুক্ত যুবলীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া সমাজের বিত্তবানদের টার্গেট করে তার গুলশানের আলিশান অফিসে নিয়ে যেতেন। সেখানে আপত্তিকর ছবি তুলে তা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক বলেন, প্রতারক চক্রের সদস্যদের মধ্যে একজন জমির মালিক সেজে অভিনব পন্থায় সহযোগী দালালদের মাধ্যমে ক্রেতা ঠিক করে তা বিক্রি করার কথা বলে মানুষজনকে প্রতারিত করছে।

গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম জানান, এক শ্রেণির প্রতারক পরিচয় গোপন করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। তারা নিজেদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যুগ্ম সচিব, ডিজি, বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক, কখনও এনজিও ব্যুরোর প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে।