শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হার্ডলাইনে আতিক, বিলবোর্ড বৈধ করতে ব্যবসায়ীদের তোড়জোড়

নিজস্ব সংবাদদাতা : অননুমোদিত (অবৈধ) বিলবোর্ড-সাইনবোর্ড অপসারণ করা হবে, মাসখানেক ধরেই বিভিন্ন সভা-সেমিনারে কিংবা প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকু্ল ইসলাম। সেই সঙ্গে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করপোরেশনে ফি জমা দিয়ে অবৈধ বিলবোর্ড-সাইনবোর্ড বৈধ করার সময়ও দেন মেয়র। কিন্তু মেয়রের এমন ঘোষণায় তখন কেউ সাড়া দেননি। উল্টো রং বে-রংয়ের বিশাল বিশাল বিলবোর্ড-সাইনবোর্ড দিয়ে শহরের আকাশ ঢেকে দেওয়া ব্যবসায়ীরা যেন ব্যস্ত-ই ছিল তাদের ব্যবসা নিয়ে। আর তারা হয়তো ভেবেছিল এমন কত ঘোষণা এলো আর গেল!

তবে অনিয়মের শহরে নিয়ম করেই রোজ যারা অনিয়মে অভ্যস্ত, তারা যে এমন নিয়ম মানবে না তা অবশ্য মেয়র নিজেও আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই মেয়র আতিক ঘোষণা দিয়েই থেমে থাকেননি। যেই কথা সেই কাজ দেখাতে ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে করপোরেশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে নিজেই মাঠে নামেন মেয়র আতিক। শুরু করেন বড় বড় অবৈধ বিলবোর্ড-সাইনবোর্ড অপসারণ কার্যক্রম। সেই সঙ্গে অপসারণ করার এ সব বোর্ড নিলামেও বিক্রি করে নগদ অর্থ আদায় করেন মেয়র।

হঠাৎ মেয়রের এমন হার্ডলাইন অ্যাকশনে ঠিক যেন ভ্যাবাচেকা অবস্থা ব্যবসায়ীদের। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে লাগানো চকচকা-ঝকঝকা বিলবোর্ডগুলো চোখের সামনেই মুহূর্তেই বুলডোজারের আঘাতে চুরমার হচ্ছে। এমনটা কল্পনাও করেননি ব্যবসায়ীরা। তাই ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা উপায়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা মেয়র আতিককে থামাতে নানা তদবিরও করেছেন। কিন্তু মেয়রের কঠোর অবস্থানের কারণে টেকেনি সে চেষ্টা। উল্টো মেয়রে অব্যাহত অ্যাকশনে শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা অবৈধ বিলবোর্ড বৈধ করতে করপোরেশনে আবেদন করতে লাইন ধরেছেন। যে কারণে মাত্র চার দিনেই বিলবোর্ডের আবেদনে ডিএনসিসি পেয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। যা এ খাত থেকে পুরো বছরের আয়ের অর্ধেক।

মেয়রের এমন অ্যাকশনে নগরবাসীর মাঝে নতুন আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। একটি সুস্থ-সুন্দর এবং সচল ঢাকা গড়তে যে প্রতিশ্রুতি মেয়র আতিক নগরবাসীকে দিয়েছিলেন। এমন অ্যাকশন অব্যাহত থাকলে সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও করপোরেশনের কর্মকর্তারা। নগরবাসীরও সেই প্রত্যাশা।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে ঘোষণা দিয়েও হার্ডলাইন যেতে না পারায় অনিয়মকারীরা সব অনিয়মকেই নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু মেয়র আতিক হঠাৎ যে অভিযান শুরু করলেন তা অব্যাহত থাকলে নগরবাসীর প্রত্যাশার ইতিবাচক সূচনা হবে। এজন্য মেয়রকে এ ধারা অব্যাহত রাখার পরামর্শও দেন তারা।

ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্ব পরিচালিত পৃথক পৃথক অভিযানে প্রায় ২ হাজার বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড অপসারণ করা হয়েছে। এ সময় এসব বোর্ড নিলামে বিক্রি ও জরিমানা বাবদ সংস্থাটি আয় করেছে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এ অভিযান শুরুর পর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিলবোর্ডের অনুমোদন নিতে পে অর্ডারের মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে সংস্থাটি। প্রতি স্কয়ার ফিট বিলবোর্ডের জন্য ডিএনসিসি নিচ্ছে আলোকিত (বৈদ্যুতিক) ১৫০ টাকা এবং অনালোকিত ১০০ টাকা।

ডিএনসিসির রাজস্ব কর্মকর্তা মো. হামিদ মিয়া বলেন, অভিযান করতে গিয়ে দেখা গেলে অধিকাংশ ব্যবসায়ীই বিলবোর্ডের অনুমোদন নেই নি। এমন অনিয়মের পরিমাণ ছোট ব্যবসায়ীদের তুলনায় বড় বড় ব্যবসায়ীরাই বেশি করেছে। আবার কেউ কেউ অনুমোদন নিয়েছে ঠিকই কিন্তু যে সাইজের জন্য অনুমোদন নিয়েছে বাস্তবে দেখা গেল তার চেয়েও বড় বানিয়েছে। তবে কেউ পার পাওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি আমরা সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকেও চিঠি দিয়েছি ফি জমা দিয়ে অনুমোদন নেয়ার জন্য।

অভিযানের বিষয়ে বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফর করিম নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘মেয়র যে অ্যাকশন শুরু করছেন। এটা আরও আগেই করা উচিত ছিল। এমন কি যেসব আইন রয়েছে তার কঠিন প্রয়োগও হওয়া প্রয়োজন। আমি নিজেও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী। তাই আমি জানি কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এ সামান্য বিলবোর্ডের কিছু টাকা দিতে পারা কোনো বিষয়ই না। সমস্যাটা হল আইনের শাসন এবং বিদ্যমান নিয়মের চর্চা না থাকায়। এখন মেয়র আতিকের এমন এ্যাকশন যদি সবসময় থাকে তাহলে ভবিষ্যতেও যারা ব্যবসা করবে তারা আর অনিয়ম করার চিন্তাও করবে না। আমরা তো মনে করি তাই হওয়া উচিত।’

একই মত দিলেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘মেয়র আতিকুল ইসলামের এমন অ্যাকশন অবশ্যই ইতিবাচক সূচনা। নিয়ম বিদ্যমান রাখতে অবশ্যই আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। যদিও সে ধারা বর্তমানে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। তাই মেয়রের এমন কর্মকাণ্ড যদি অব্যাহত থাকে তবে অবশ্যই জনগনের জন্য সুফল বয়ে আনবে। সেই সঙ্গে সফল মেয়র হিসেবেই আতিকু্ল ইসলাম পরিচিতি লাভ করবে।’

এ বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকু্ল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর দেখলাম ৩৬৫ দিনের জন্য এ খাত থেকে বাজেট ছিল ৩ কোটি টাকা। কিন্তু ঠিক মত সে টাকাও কেউ পরিশোধ করেনি। তাই এবার আর সেই সুযোগ দিবো না। সবাইকে নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। এতো দিন অনিয়ম করে পার পেয়ে গেছে মনে করেই কেউ আমার ঘোষণাকে আমলে নেয়নি। কিন্তু যখন ঘোষণা বাস্তবায়ণ শুরু করলাম তখনই শুরু হলে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ। কেউ কেই বলছে যে তারা জানতো না বিলবোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু লাইসেন্স পেপারে এ বিষয়ে স্পষ্ট বলা আছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি যখন দেখলাম অবৈধ বিলবোর্ড বৈধ করতে সময় বেঁধে দেয়ার পরও কেউ সাড়া দিচ্ছে না। তখন-ই হার্ডলাইনে যেতে বাধ্য হলাম। অভিযান শুরু করার পর বড় বড় ব্যবসায়ীরা ফোন দেওয়া শুরু করলেন। অনুরোধ করতে লাগলেন তাদের বিলবোর্ড না ভাঙতে। কেউ কেউ প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে দিয়েও অনুরোধ করিয়েছেন। কিন্তু আমি স্পষ্ট বলেছি, এটা তো এমন কিছু না যে আমি হঠাৎ করেই শুরু করেছি। আমি তো ঘোষণা দিয়েছি। সময় দিয়েছি। তখন তো কেউ ফোন করেননি। এখন কেন?’

মেয়র আতিক বলেন, ‘অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যে হারে ফোন আসা শুরু করেছিল এক পর্যায়ে আমি ফোনই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। আমি কোনো প্রভাবশালীর মেয়র নই, আমি জনগণের মেয়র। তাই জনগণই আমার শক্তি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। আমি নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেছি। তাই শুধু বিলবোর্ড নয়, প্রতিটি সেক্টরে হার্ডলাইনে থাকবে আমার অবস্থান। নিয়মে ফিরতে হবেই।’

জনবল সংকটের কারণে কিছুটা ধীর গতিতে এগুতে হচ্ছে জানিয়ে আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার করপোরেশনের জনবলের সংকট রয়েছে। কিন্তু যা আছে আমি তা নিয়েই আপাতত কাজ চালাচ্ছি। যে কারণে একযোগে সব এলাকায় শুরু করতে পারছি না। তাই বলে গুলশানে অভিযান চালাচ্ছি কিন্তু উত্তরা কিংবা মোহাম্মদপুরে অভিযান হবে না, এমনটা নয়। দুদিন আগে-পরে সেগুলোতেও অভিযান হবে। এ জন্য আরও ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পেতে আবেদন করেছি। আগামী সপ্তাহেই শুরু করব উত্তরায়। আমি হিসেব করে দেখেছি এ অভিযানে প্রায় ১৫ কোটি টাকার মতো আয় হবে শুধু এ বিলবোর্ড থেকে। যা এতোদিন ফাঁকি দিয়েছিল ব্যবসায়ীরা।’