মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচার বিমুখ শেখ রেহানা নির্মোহ চরিত্রের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ

নিজস্ব সংবাদদাতা : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদরের ছোট কন্যা,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সালে। শ্যামল ছায়া ঘেরা মধুমতির তীরে ছোট্ট গ্রাম টুঙ্গীপাড়ায়। তিনি বাংলার একজন সাধারণ মায়ের মত জীবনাচরণ করেন। তাঁর সাদামাটা জীবনযাপন ও অতিথিপরায়ণতা সকলেরই জানা। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সংগ্রাম করে দেশের জন্য নীরবে নিবৃত্তে কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গমাতার সুযোগ্য উত্তরসূরিই তাঁকে মনে হয়। মা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে, সাহস পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, ঠিক তেমনই বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থেকে তিনি পরামর্শ,অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্য থেকেই আমরা সকলেই জানি, ছোট বোন তাঁর কত বড় পরামর্শদাতা।

শেখ রেহানা যখন বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই দেখেছে তাঁর পিতা বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের জন্য মাসের পর মাস কারাগারে থাকছেন। কারাগারই পিতার আসল ঠিকানা। শৈশব ও কৈশোরে পিতৃ স্নেহ থেকে ছিলেন বঞ্চিত। এক স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন, ‘ছোট বেলা দেখতাম আব্বা প্রায় সময়ই জেলে থাকতেন। আব্বা যখন বাইরে থাকতেন কিংবা মুক্ত থাকতেন,তখনই আমাদের কাছে ঈদ মনে হত। আব্বাও জেলের বাইরে, ঈদও এলো এমন হলে তো কথাই নেই। আমাদের হতো ডাবল ঈদ’।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের দিন। যেদিন জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। বড় বোনের সাথে শেখ রেহানা তখন ব্রাসেলসে ছিলেন। প্রাণে বেঁচে গেলেও পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়ে দুই বোন এতিম হয়ে যান। ব্রাসেলস থেকে জার্মানী হয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় ভারতে আশ্রয় নেন। শুরু হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জীবন।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন,‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। বিশ্বাস তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে। আমরা যদি সবার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতাম তাহলে ১৫ আগস্টের পর তো দুই বোন ঘরেই বসে থাকতাম। কার ভিতর কি আছে বলা মুশকিল হলেও সবার উপর থেকে তো বিশ্বাস তো হারানো যায় না। যে রাজনীতি ছোট্ট বয়সে নিজেদের কাছ থেকে বাবাকে সবসময় বিচ্ছিন্ন রাখত, সেই রাজনীতি যখন পুরো পরিবারকে ছিনিয়ে নিল, এমন মনোভাব নিজের ভিতরে কাজ করলেও একসময় এসে মনে প্রশ্ন জেগেছে,পুরো পরিবার নিয়ে গেলেও আল্লাহ কেন তাদের দুই বোনকে বাঁচিয়ে রাখলেন। নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার কোন উদ্দেশ্য আছে? মনে হলো-এই খুনিদের ধরার জন্যই হয়তো আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন’।

তারপর পড়ালেখার কথা ভাবলাম। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শান্তি নিকেতনে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিরাপত্তা দিতে রাজি না হওয়ায় লন্ডন যেতে হলো। লন্ডনে সে এক নতুন পরিস্থিতি। তিনি তখন মাত্র বিশ বছরের একজন তরুণী। নিজেই নিজের অভিভাবক। প্রথমে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন একটা চাকরি। চাকরি হল একটি লাইব্রেরি ও পাবলিশার্স কোম্পানিতে। পরিচিত সবার আচরণ মুহূর্তেই অপরিচিত মনে হলো। তখন নিজের একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তার অনুভব হলে ১৯৭৭ সালে ড.শফিক সিদ্দিকের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. সিদ্দিক তখন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। যদিও বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেই বিয়ের কথা চূড়ান্ত হয়েছিল। সেদিন পরিবারের একমাত্র আপনজন বড় বোন শেখ হাসিনা টাকার অভাবে ছোট বোনের বিয়েতে উপস্থিত হতে পারেন নি।

তারপর আস্তে আস্তে নেমে পড়েন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে জনমত গঠন করতে। ১৯৭৯ সালের ১০ মে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে বড় বোন শেখ হাসিনার নাম দিয়ে ব্যানার টানিয়ে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা। তারপর থেকে লন্ডনসহ ইউরোপের প্রতিটি দেশে বিচারের দাবিতে সভা সমাবেশ করে ঘাতকদের বিচার ও স্বৈরশাসকদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে নিরলস ভাবে কাজ করে যান।

১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গমাতার ভূমিকায় গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি বাংলার ইতিহাসকে পরিবর্তন করেছিল ঠিক তেমনি ১/১১ সরকারের সময় বড় বোন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্ত ও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

জীবনের একটি দীর্ঘ সময় সংগ্রাম ও কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তবুও কখনও সততাকে বিসর্জন দেন নি, নীতির প্রশ্নে আপস করেন নি। নিজের একমাত্র বড় বোন দেশের প্রধানমন্ত্রী অথচ তিনি লন্ডনে অন্যের অফিসে কাজ করেছেন। গণপরিবহনে যাতায়াত করতেন। অথচ তিনি চাইলেই অনেক বিত্ত বৈভবের মালিক হতে পারতেন, সেটা তিনি কখনও হতে চান নি। সততার এমন মহৎ দৃষ্টান্ত শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের পক্ষেই সম্ভব।

তিনি এতটা প্রচার বিমুখ, নির্মোহ চরিত্রের যে বাইরে থেকে তাঁর সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছুই জানতে পারে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকেই মাঝে মাঝে আমরা আমজনতা কিছুটা জানতে পারি। যখন রোহিঙ্গারা স্রোতের মত বাংলাদেশে আসতে লাগলো তখন তিনি বলেছিলেন তাঁর বড় আপাকে, যদি ১৮ কোটি জনগণকে তুমি খাওয়াতে পার তাহলে ১১ লক্ষ লোককেও খাওয়াতে পারবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি বক্তব্যে বলেছিলেন, রেহানা আমাকে একথা বলার পর আমার সিন্ধান্ত নিতে একটুও দেরি হয়নি। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করি। তিনিই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রধান পরামর্শ দাতা। সকল দুর্যোগ দুঃসময়ে ছায়ার মত তিনি তাঁর বড় আপার পাশে আকঁড়ে থাকেন।

তিনি একজন রত্নাগর্ভা মা। বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক বৃটেনের লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রী ও তিন-বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। একমাত্র ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় কর্মরত। আওয়ামী লীগের গবেষণা কাউন্সিল সিআরআইয়ের সাথে যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, ছোট মেয়ে কন্ট্রোল রিস্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক এ্যানালাইসিস সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।

তিনি আপা শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, আপা তুমি বড়,তাই তুমি রাজনীতি কর,দেশের জন্য কাজ কর আমি ছেলে মেয়েদের দেখাশুনা করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন,আমাদের পরিবার বলতে আমাদের পাঁচ সন্তান ও আমরা দুই বোন। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানাও পাঁচ সন্তানকেই একই ভাবে দেখাশুনা করে বড় করছেন। আজ প্রতিটি সন্তানই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত।

করোনাকালে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অসহায় অস্বচ্ছল মানুষদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করছেন তখন ছোট বোন শেখ রেহানা সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের আমতৈল গ্রামের ৪৬১ জন প্রতিবন্ধীর থাকা ও তাদের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বড় বোনের দৃষ্টিগোচর করেন। তখনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর্থিক অনুদানসহ তাদের জীবনযাত্রা উন্নয়নে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী আরেকটি বক্তব্যে বলেছেন যে,রেহানা তাঁকে স্মরণ করে দিয়েছে যারা রিক্সায় ডিজাইন করে সেসব লোকদের কেও যেন সাহায্যের আওতায় আনা হয়। একজন ব্যক্তির কতটা দেশপ্রেম, দেশের জনগণের প্রতি ভালবাসা থাকলে এতদূর পর্যন্ত চিন্তা করতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়েও তিনি কখনও সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন নি। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে নেপথ্যে থেকে সবসময়ই কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আওয়ামী লীগের কোন নেতা নন, নেই কোন রাষ্ট্রীয় পদে। তবে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে, ক্রান্তিকালে আশা ভরসার স্থল হয়ে উঠেন। প্রতিটি কাউন্সিলের আগে একটি কথা আসে শেখ রেহানা এবার গুরুত্বপূর্ণ পদে আসবেন। কিন্তু প্রতিবারই নেতাকর্মীদের আশা ভঙ্গ হয়। বরাবরই তিনি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখান না। অন্তরালেই থেকে যান।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘এই দিনে আমরা সকলে মিলে অঙ্গীকার করি- আমাদের যা কিছু আছে,তাই দিয়ে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। সুন্দর, সমৃদ্ধ এবং দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও নিরক্ষরতামুক্ত দেশ গড়ব। সোনার বাংলাকে ভালবাসব। পরশ্রীকাতরতা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখব। ঘরে ঘরে মুজিবের আদর্শের দূর্গ তৈরি করে তার আলো ছড়িয়ে দিব। কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’।

তিনি বাঙালি নারীদের আদর্শ। কিভাবে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া যায়, ক্ষমতার লোভ থেকে নিজেকে দূরে রাখা যায়, কোন পদে না থেকেও দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করা যায়, সেটা তিনি দেখিয়েছেন। তাঁর এই নির্মোহ চরিত্রই বাংলাদেশের ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকবে। সেই,প্রচারবিমুখ মহীয়সী নারীর শুভ জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
haldertapas80@ gmail.com