সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

আউটসোর্সিং কর্মীদের মাধ্যমে হচ্ছে এনআইডি জালিয়াতি

নিজস্ব সংবাদদাতা : জাতীয় পচিয়পত্র (এনআইডি) সেবা প্রদান করে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ। এই বিভাগে অধীনে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের লক্ষ্যে ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং এক্সেস টু সার্ভিস’ (আইডিইএ) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের অধীনে আউটসোর্সের মাধ্যমে নিয়োগ করা কর্মীদের জাতীয় পরিচয়পত্র সেবার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভোটার করাসহ এনআইডি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আউটসোর্সের অনেক কর্মী।

গত শনিবার নির্বাচন কমিশনের দুই ডেটা এন্ট্রি অপারেটরসহ জাল এনআইডি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এছাড়াও এনআইডি জালিয়াতির কয়েকটি ঘটনায় আউটসোর্স কর্মীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। 

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে এনআইডি সেবা চালাতে গেলে পদ সৃষ্টি করতে হবে। পদ সৃষ্টি করতে গেলে, প্রকল্প নিতে হলে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। এজন্য আমরা সরকারের কাছে লিখছি, বলছি। এটা হলে আউটসোর্সিং থাকবে না। 

তিনি আরও বলেন, স্থায়ী জনবল নিয়োগের আগ পর্যন্ত আমাদের আউটসোর্সিংয়ের লোক দিয়ে কাজ চালাতে হবে। সে ক্ষেত্রে কোনো রকম অভিযোগ পেলে অ্যাকশন নিচ্ছি।

এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি জালিয়াতচক্রের সঙ্গে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া অস্থায়ী কর্মী ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে চক্রের অনেকে জড়িত থাকার তথ্য আসছে। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মাঠপর্যায়ে অনিয়ম রোধে অভিযানের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, আইডিইএ প্রকল্পের অধীনে সারাদেশে ৫১৮ উপজেলা নির্বাচন কার্যালয় ও এনআইডি কার্যালয়ে প্রায় ১৩শ ডাটা এন্ট্রি অপারেটর কাজ করছেন। প্রকল্পের মাধ্যমে নিয়োগকৃত এসব আউটসোর্স কর্মীরা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, বিতরণ ও ভোটার রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ করে থাকেন।

কাজী শাহজালাল নামের এক ব্যক্তি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার বাইক দক্ষিণ ইউনিয়নের ভাবকপাড়া গ্রামের ভোটার হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অথচ লাকসাম উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এমন ভোটারের কোনো তথ্য নেই।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে নূর মোহাম্মদ নামে এক রোহিঙ্গা ডাকাত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। পুলিশের তথ্য অনুসারে সে টেকনাফের হ্নীলার জাদিমোরা-২৬ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা ছিল। তার বাড়ি মিয়ানমারের আকিয়াবের জেলার মংডু শহরের বুড়া সিকদারপাড়া গ্রামে। মৃত্যুর সময় তার কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্ট কার্ড) পাওয়া যায়। 

গত বছরের ১৮ আগস্ট রমজান বিবি নামের এক রোহিঙ্গা নারী লাকী নাম দিয়ে স্মার্ট কার্ড উত্তোলনের জন্য এনআইডি নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে যান। সার্ভারে লাকীর যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত আছে দেখা যায়। লাকীর কথাবার্তায় সন্দেহ হলে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে জানানো হয়, ভোটার হিসেবে নিবন্ধন বা লাকীর নামে জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়নি। কাগজপত্রে কোথাও কিছু নেই। এ ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আরও ৪৬টি ভুয়া এনআইডির তথ্য ইসির সার্ভারে পাওয়া যায়। নির্বাচন কার্যালয়ের নথিপত্রে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।

এই ঘটনায় চট্টগ্রামের ডবলমুরিং নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল পুলিশকে জানায়, ২০০৪ সালে সে অফিস সহায়ক হিসেবে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে যোগ দেয়। ২০০৭ সালে আইডিইএ প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া সত্যসুন্দর দে ও সাগর নামের দুই কর্মীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সাগরের কাছ থেকে সে ১০ হাজার টাকায় ২০০৭ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকার কার্যক্রমে ব্যবহৃত ল্যাপটপ কেনে। যেটিতে ইসি সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সফটওয়্যার ও ইউজার-পাসওয়ার্ড ছিল।

ইসি সূত্র জানায়, সত্যসুন্দর দে আইডিইএ প্রকল্পে টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করত। ২০১২ সালে সই জাল করে এনআইডি সংশোধনসহ দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়। এরপরও অসাধু এই কর্মকর্তাকে দিয়ে নানা কাজ করান ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা। গত বছরের ভোটার তালিকা হালনাগাদে ঢাকার একটি অঞ্চলের টিম সিলেকশনের নিয়োগ কর্তৃপক্ষ হিসেবেও কাজ করেছে সে। ঢাকা জেলা নির্র্বাচন অফিস তাকে নিয়োগ দেয়।

সাগরও টেকনিক্যাল সাপোর্ট হিসেবে কাজ করত। ২০১৩ সালে দুর্নীতি-অনয়িমের কারণে বরখাস্ত হয়। এরপরও তাকে এনআইডির কাজ করতে প্রায়ই ইসিতে দেখা যায়। মোস্তফা ফারুক জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের একটি প্রকল্পে টিম লিডার হিসেবে কাজ করত। দুর্নীতির দায়ে ২০১৪ সালে বরখাস্ত হয়। এরপরও নিজ এলাকা চট্টগ্রামের নির্বাচন অফিসে কাজ করেছে। বিষয়টি জানতে পেরে ইসি থেকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে মোস্তফা ফারুককে ইসি অফিসের কোনো কাজে যুক্ত না করার জন্য বলা হয়। এরপরও তাকে সর্বশেষ ভোটার তালিকা হালানাগাদ কার্যক্রমে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও বোয়ালখালী এলাকায় কাজ করতে দেওয়া হয়। তাকে নিয়োগ দেয় চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিস।

গত সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা নারী ভোটারকরণে সম্পৃক্ততায় মোস্তফা ফারুক, সত্যসুন্দর, ঢাকা কার্যালয়ের অস্থায়ী কর্মচারী শাহনুর মিয়াসহ এনআইডি জালিয়াতির মামলায় ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে ১১ জন ইসির কর্মী, যাদের চারজন স্থায়ী ও সাতজন অস্থায়ী। বাকিরা তাদের সহযোগী।

এরপর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের ডিজি সাইদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এর সঙ্গে কত জন জড়িত। তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার স্বার্থে আমরা এখনই তাদের নাম প্রকাশ করছি না। আমরা পর্যায়ক্রমে তাদের নাম প্রকাশ করব। কিন্তু এরপর এনআইডি জালিয়াতিরোধে তেমন দৃশ্যমান অগ্রগতির খবর মেলেনি। এমনকি শাহনূর মিয়ার জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়েও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

ইসি কর্মকর্তরা জানান, ছবিসহ ভোটার তালিকা করা হয় ২০০৮ সালে। এরপর এক যুগ অতিবাহিত হলেও এনআইডি সেবার জন্য কমিশন নিজস্ব লোকবল নিয়োগ দেয়নি। আউটসোর্সের লোক দিয়ে এনআইডি সার্ভারের কাজ করানো হচ্ছে। এই কর্মচারীদের অনেকে ইসির কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় জালিয়াতি করে থাকে। কোনো জালিয়াতির বিষয় প্রকাশের পর সাময়িক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পেছন থেকে কাজ করা কর্মকর্তাদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।

বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপির সহায়তায় আইডিইএ প্রকল্পের আওতায় ২০১১ সালের জুলাইয়ে ৯ কোটি নাগরিককে উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার চুক্তি হয়। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের জুনে। এরপরে বেশ কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অর্ধেক ভোটারের হাতেও স্মার্ট কার্ড পৌঁছে দিতে পারেনি এনআইডি উইং। এ প্রকল্পে নিয়োগকৃত আউটসোর্স কর্মচারীদের দিয়ে চলছে এনআইডির কাজ।

সম্প্রতি জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশের পর এনআইডি উইং জানিয়েছে, ইসির ডেটাবেইজ সুরক্ষিত। এখন উপজেলা পর্যায়েও সার্ভারে ৫ স্তরের নিরাপত্তা সিস্টেম চালু করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা আইডিইএ প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে জানাতে নির্দেশনা রয়েছে। ৫১৮ জন থানা/উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, আই পিপল লিমিটেডের চেয়ারম্যান, ই জোন এইচআরএম লিমিটেডের পরিচালক ও প্রোএমস এর চিফ কনসালটেন্টকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল এনআইডি উইংয়ের ডিজি সাইদুল ইসলাম বলেন, জালিয়াতচক্রকে আমরা সমূলে নির্মূল করব। আমাদের অবস্থান কঠোর; অপরাধীদের কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। সাঁড়াশি অভিযানের লক্ষ্যে ইসি সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এনআইডি উইং ও প্রকল্পের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে ১০টি আঞ্চলিক পর্যায়ে বিশেষ টিম করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের ডিসি রাজীব আল মাসুদ বলেন, এনআইডি জালিয়াতের ঘটনায় শনিবার গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেকের নাম আসছে। তাদের দেওয়া তথ্য আমার যাচাই করছি। এর সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা আছে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এ দিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভোটার হওয়ার সন্দেহে ১৭টি জাতীয় পরিচয়পত্র সাময়িকভাবে ব্লক করা হয়েছে। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনসাপেক্ষে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে এনআইডি উইং।