শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইনে পাঠদানে অগ্রগতি ও বাস্তবতা

নিজস্ব সংবাদদাতা : করোনা মহামারীর সময়ে শিক্ষা ব্যাবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন শিক্ষার প্রতি জোরদার করছে। করোনার এই সঙ্কটের সময়ে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় নিম্ন ক্লাসের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সবাই অনলাইন শিক্ষার বিষয়ে বেশ সচেতন। তবে প্রচার প্রচারণার এগিয়ে থাকলেও অনলাইন শিক্ষায় বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের  মাত্র ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ এই অনলাইন শিক্ষার সুবিধা নিতে পারছে।অনলাইন শিক্ষা বা প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট ডিভাইস, বিদ্যুৎবিভ্রাট এবং ইন্টারনেটের উচ্চমূল্যের কারণে  মোট শিক্ষার্থীদের সিংহভাগ অর্থাৎ  ৮৫ শতাংশ অনলাইন শিক্ষা সম্পর্কিত এই টার্মের সাথে ব্যাপকভাবে পরিচিত হলেও তারা এখনো অনলাইন শিক্ষার সুবিধার পুরোপুরিই বাইরেই রয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি আয়োজিত এক ওয়েবিনারে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যেও অনলাইন শিক্ষার নানা সীমাবদ্ধতার বিষয়টি উঠে আসে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পাঠদানের মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও মোটের ওপরে প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর অনলাইন শিক্ষা অর্থাৎ ক্লাসের প্রতি আগ্রহ নেয়। প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের বিপুল শিক্ষার্থী যেখানে অনলাইন থেকে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারছে না সেখানে কলেজ বা স্কুলপর্যায়ের শিক্ষার্থীরা  নিঃসন্দেহে আরো বেশী বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফলাও করে অনলাইনে পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের অভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই নাজুক।
দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারনে ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অধ্যায়নের সাথে সংযুক্ত রাখতে  পরীক্ষা মূলক অনলাইন ক্লাস  শুরু করে গত জুন মাসে। শুরুর দিকে  মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের  শিক্ষার্থীদের মাঝে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের ওপর পরীক্ষামূলক একটি জরিপ চালানো হয়। সেখানে দেখা গেছে, মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে তাদের পাঠ গ্রহণ করতে পারছেন। বাকি ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অনলাইনে পাঠকার্যক্রম গ্রহণ করতে পারছেন না। পলিটিকাল সায়েন্সের অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না।এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষার সাথে সংযুক্ত হতে পারছে না।আবার যারা ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে তারা সম্পূর্ণ ক্লাস করতে পারছে না নেটওয়ার্ক,মেগাবাইট ও মোবাইল চার্জজনিত সমস্যার কারনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান শিক্ষার্থীরা অনলাইনে কতটুকু শিক্ষা লাভের সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে তার একটি প্রাথমিক জরিপ করেছেন। জরিপ সম্পর্কে ডঃ সলিম রায়হান আশাব্যঞ্জক কোনো সাড়া পাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে শিক্ষায় আগ্রহী নন।বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস উপস্থিতির হার নাজুক তাহলে বাকি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের উপস্থিত হার আরো নাজুক হওয়ার কথা। এই সিংহভাগ শিক্ষার্থীদের দূরে রেখে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের উন্নতি সম্ভব নয়।
করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ছুটির এই সময়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপর্যায়েই নয়, স্কুলপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে  দেখা গেছে, করোনার সময়ে সব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ৮০ শতাংশ কমেছে। এক দিকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অন্য দিকে কোচিং, প্রাইভেট এবং গৃহশিক্ষকদের মাধ্যমে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। ফলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকা শিক্ষার্থীরা এখন বাসাবাড়িতেই অলস সময় কাটাচ্ছে।অধিকাংশ শিক্ষার্থী মুভি,ইউটিউব,গেইম ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে নিজেদের অবসর সময় পার করছেন।
আমাদের দেশের মূল শক্তি হলো কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্ভাবনী পদক্ষেপ। করোনায় আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে সে জন্য তাদেরকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত রাখতে হবে। আর এই কাজটি সুচারুভাবে করতে পারলেই আমাদের নতুন প্রজন্ম অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থা ভয়ানক ক্ষতির মুখে পড়েছে।এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে টেলিভিশন ও অনলাইনে শ্রেণী কার্যক্রম চলছে; কিন্তু মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেক বর্তমানে টেলিভিশনে আর ১৭ শতাংশ অনলাইনে লেখাপড়ায় যুক্ত হচ্ছে। দারিদ্র্য, ইন্টারনেটের ধীরগতি এবং বিদ্যুৎবিভ্রাটসহ অন্যান্য কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়পক্ষকে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে।আমরা যদি এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে না পারি তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীদের অভাবনীয়  ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।  [মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]


লেখক-সাইফুল্লাহ মানছুর

শিক্ষার্থী-দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়