শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতিসহ ১৩ সূচকে ফের রেড জোনে বাংলাদেশ

নিজস্ব সংবাদদাতা : নানা পদক্ষেপের পরও কোনোভাবেই উন্নতি হচ্ছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশনের (এমসিসি) মূল্যায়নে বাংলাদেশের অবস্থান। চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অধিকারসহ ১৩টি সূচকে ফের রেড জোনে (খারাপ অবস্থান) নাম উঠেছে।

এর আগের তালিকায় (২০১৯-২০) ছিল একই জোনে ১২টি সূচক। এবার নতুন করে যোগ হয়েছে ফিসক্যাল পলিসি (রাজস্বনীতি)। আর ২০১৮-১৯ সালে ছিল ১১টি এবং ২০১৭-১৮ সালে ছিল ৭টি সূচক।

সম্প্রতি প্রকাশিত এমসিসি ‘বাংলাদেশ স্কোর কার্ড-২০২০-২১’ শিরোনামের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। ২০টি সূচকের মধ্যে অধিকাংশই লাল চিহ্ন হওয়ায় এবারও মিলছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডের (এমসিএফ) মোটা অঙ্কের অনুদান।

স্কোর কার্ডের উন্নতির ভিত্তিতে এ ফান্ডে যুক্ত হয় বিভিন্ন দেশের নাম। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পক্ষ থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর চেষ্টা করেও এ ফান্ডে যুক্ত হতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইআরডির আমেরিকা উইংয়ের যুগ্ম সচিব কবীর আহমেদ রোববার বলেন, অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু স্কোরের উন্নতি করা যায়নি। এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বিষয়।

এমসিসি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এ মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তারা আমাদের তথ্য খুব বেশি গ্রহণ করতে চায় না। ফলে এক্ষেত্রে উন্নতি করাটা প্রায় দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবে আমরা আবারও চেষ্টা শুরু করব। যাতে এ ফান্ডে যুক্ত হওয়া যায়।

ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, স্কোর কার্ড উন্নতির ক্ষেত্রে অনেকটাই রাজনীতি যুক্ত রয়েছে। সেখানে ইআরডির তেমন কিছুই করার নেই। কেননা এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে।

আমেরিকার সঙ্গে যখন তাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তখন এ বিষয়টি উপস্থাপন করা যেতে পারে। আমরা (ইআরডি) সরকারের কোনো বার্তা থাকলে সেটি এমসিসির কাছে তুলে ধরে থাকি। তবে অনেক বছর ধরে চেষ্টা চালালেও সফলতা আসছে না।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্কোর কার্ডে রেড জোনে থাকা বাংলাদেশের সূচকগুলো হচ্ছে- কন্ট্রোল অব করাপশন (দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ), জমির অধিকার ও প্রাপ্যতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা, বাণিজ্য নীতিমালা, ফ্রিডম অব ইনফরমেশন (তথ্যের স্বাধীনতা), অর্থনীতিতে নারী ও পুরুষের সমতা, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয়, প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা সূচক। এছাড়া রাজনৈতিক অধিকার, বেসামরিক লোকের স্বাধীনতা, মেয়েশিশু প্রাথশিক শিক্ষা সমাপ্ত করার হার এবং নতুন করে গ্রিন থেকে রেডে উঠেছে ফিসক্যাল পলিসি (রাজস্বনীতি)।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় দুর্নীতি নিয়ে যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করেছি, এমসিসির প্রতিবেদনে সে সবেরই প্রতিফল ঘটেছে।

বারবার আমরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করছি সেটি হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর কিছুই হয়নি। সেজন্য বারবার এ সূচক থাকছে লাল তালিকায়। প্রধানমন্ত্রী জোরালোভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছেন।

কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি প্রতিরোধের কথা তাদের একাংশ এ দুর্নীতিকে সমর্থন, সহায়তা এবং নিজেদের স্বার্থে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে বাংলাদেশ যেমন আন্তর্জাতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি দেশের অসম্মান করা হচ্ছে।

সরকারের উচিত এসব মূল্যায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। এক্ষেত্রে শুধু মুখের কথা নয়, কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

এছাড়া প্রতিবেদনের সবুজ তালিকায় যে সাত সূচকে বাংলাদেশ আছে, সেগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, টিকা দেয়ার হার, শিশু স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সরকারের কার্যকারিতা, ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ এবং বিজনেস স্টার্টআপ (ব্যবসা শুরুর) সূচক।

ইআরডি জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড গঠন করে এবং এটি পরিচালনার জন্য ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি)। ফান্ড গঠনের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।

এমসিএফের আওতায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচিত দেশগুলোকে সহায়তা করে থাকে। এর একটি হচ্ছে থ্রেসহোল্ড কান্ট্রি বা কম অঙ্কের সহায়তার দেশ। এ প্রোগ্রামের আওতায় সাধারণত ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত অনুদান প্রদান করা হয়ে থাকে।

অন্যটি হচ্ছে কমপ্যাক্ট অর্থাৎ বড় অঙ্কের সহায়তা। এর আওতায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান দেয়া হয়ে থাকে। এ ফান্ডের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যুক্ত করতে প্রতি বছর বৈঠক করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি)।

কোন দেশকে মূল্যায়নের জন্য প্রথমদিকে ১৭টি নির্দেশক থাকলেও সর্বশেষ ২০১২ সালে নতুন নির্দেশকসহ ২০টি নির্দেশক যুক্ত করা হয়। ওই বছরই প্রথমবারের মতো মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।

সে সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরের সময় ওই ফান্ডে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তাকে অনুরোধ জানানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিল সরকারের প্রতিনিধিও।

ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতি বছর বাংলাদেশের পার্টনারশিপ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল।

এর মধ্যে এমসিএফের বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে টেকনিক্যাল টিম পাঠাতে বলেছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল টিম পাঠানো হলেও চ্যালেঞ্জ ফান্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আর এগোয়নি।

ইআরডির সাবেক অতিরিক্ত সচিব (সরকারের সাবেক সচিব) আরাস্তু খান বলেন, এটি নির্ভর করে অনেকটাই রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর।

ইআরডির সরাসরি স্কোরের উন্নতি কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। তাছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিশেষ কার্যক্রম দরকার।