শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে ২২ পদক্ষেপ

নিজস্ব সংবাদদাতা : হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য, যত্রতত্র বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন, নকল ওষুধ কারখানা বন্ধ, চিকিৎসকদের সুনির্দিষ্ট বদলি, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ফি, ওষুধ কোম্পানি থেকে উপঢৌকন নেওয়া, ল্যাব বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে কমিশন নেওয়া বন্ধ করা- স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে এমন ২২টি বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

জেকেজি, রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতে একের পর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বেরিয়ে আসে কেনাকাটায় দুর্নীতি থেকে শুরু করে অফিস সহকারী, ড্রাইভারদের বিপুল বিত্তবৈভব আর সব পর্যায়ে সিন্ডিকেটের কাহিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর-সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’ গঠন করেছে। ওই টিম হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুসন্ধান করে দুর্নীতি রোধে বেশ কিছু সুপারিশ করে। 

সম্প্রতি স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নানের সভাপতিত্বে দুদকের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এই ২২ পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে। এসব বন্ধে নজরদারি কঠোর করতে হবে। যেখানে যে ধরনের নীতিমালা দরকার, তা করতে হবে।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে- সরকারি হাসপাতালগুলোতে সংঘবদ্ধ দালালচক্রের ওপর নজরদারির জন্য মনিটরিং টিম গঠন করা হবে। দালালদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে ওই টিম। সভায় স্বাস্থ্য সচিব বলেন, অনেক ঠিকাদার চাকরি দেওয়ার কথা বলে বা চাকরি স্থায়ী করে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা নেন। এসব ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। 

সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ১৬ থেকে ২০তম গ্রেডে সরাসরি লোকবল নিয়োগ দেওয়ার আদেশ জারি করা হলেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ ও অনৈতিক লেনদেন হয়ে থাকে। তিনি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার কথা জানান। তার এ প্রস্তাবে সভায় আউটসোর্সিং নিয়োগ নিরুৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য নতুন করে নীতিমালা করার কথাও জানান কর্মকর্তারা।

প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনে নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে সভায়। এতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে যত্রতত্র ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন বন্ধ করতে হবে। ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন, দক্ষ টেকনিশিয়ান থাকাও বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা নকল ওষুধ উৎপাদনের কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সভায়। স্বাস্থ্য সচিব বলেন, নকল ওষুধ প্রস্তুতকারী কারখানা দামি ওষুধগুলো উৎপাদন ও সরবরাহ করে। এসব কারখানা বন্ধ করা জরুরি। এ জন্য তিনি নজরদারি জোরদার করে কারখানা চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক সিলগালা করার নির্দেশ দেন। 

এ সময় অতিরিক্ত সচিব শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ঢাকার অনেক এলাকায় রাস্তার নিচে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে নকল ওষুধ কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা সিলগালা করার পাশাপাশি মালিক, কর্মচারী সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

চিকিৎসকদের বদলিতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত হয় সভায়। ওই নীতিমালায় প্রতিটি স্টেশনে চিকিৎসকদের অবস্থান বাধ্যতামূলক করা হবে। 

স্বাস্থ্য সচিব বলেন, সিভিল সার্জন, ইউএইচএফপিও পদগুলো প্রশাসনিক। বদলি নীতিমালায় এসব পদে নিয়োজিতদের নিজ জেলায় পদায়নের সুযোগ রাখা যাবে না। উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের কমপক্ষে দুই বছর কাজ করা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। যেসব চিকিৎসক উপজেলায় দুই বছর কাজ করবেন না, তাদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে ইন্টার্নশিপ এক বছর থেকে বাড়িয়ে দুই বছর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বছর উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে অবস্থান বাধ্যতামূলক করা হবে। এ বিষয়ে মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটদের জন্য ইন্টার্নশিপ ট্রেনিং প্রোগ্রাম নীতিমালা করা হবে। চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ফি নেওয়ার ক্ষেত্রেও একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ নীতিমালায় রোগীদের আর্থিক অবস্থা এবং চিকিৎসকদের ডিগ্রি বিবেচনা করা হবে।

চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) পরিচ্ছন্ন, পাঠযোগ্য, ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা হবে। এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অফিস আদেশ জারি করবে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের থেকে চিকিৎসকদের উপঢৌকন নেওয়া বন্ধ করারও উদ্যোগ রয়েছে। এ জন্য ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাসপাতালে ঢোকা বন্ধ করে তাদের হাসপাতাল থেকে দূরে অবস্থান নিশ্চিত করা হবে।

সভায় স্বাস্থ্য সচিব বলেন, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কারণে রোগীরা হয়রানির শিকার হন। এমনকি চিকিৎসকরা উপঢৌকনের লোভে সঠিক ওষুধ দেন না। একই সঙ্গে রোগীদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ল্যাব বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরামর্শ দিতে পারবেন না চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা যাতে এই কাজটি না করেন, সে জন্য একটি নির্দেশিকা তৈরির কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই নির্দেশিকা চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হবে।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে সরকারি সব হাসপাতালে জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় এমন জায়গায় ওই হাসপাতালে কী কী সেবা দেওয়া হয়, তা প্রচার করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পরিদর্শনসহ নিজ এলাকা ভ্রমণের সময় হাসপাতাল পরিদর্শন করবেন এবং সেবাগুলো প্রদর্শন করা হচ্ছে কিনা, তা দেখবেন। জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন ও কমিউনিটি হাসপাতালে কী পরিমাণ ওষুধ আছে এবং ওইসব হাসপাতালে কী কী ওষুধ সরবরাহ করা হয়, তা জনসাধারণ জানতে পারে না। এখন থেকে হাসপাতালের স্টকে কী কী ওষুধ আছে, তা প্রতিদিন ডিজিটাল ব্যানারে প্রচার করতে হবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অফিস আদেশ জারি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি হাসপাতালে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ওষুধের তালিকা ও প্রতিটি স্বাস্থ্য পরীক্ষার (ডায়াগনসিস) মূল্যতালিকা জনসমক্ষে প্রদর্শন করতে হবে। ওষুধ ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে ইজিপিতে টেন্ডার করতে হবে। যদিও স্বাস্থ্য সচিব ওই বৈঠকে দাবি করেন, বর্তমানে ওষুধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ইজিপিতে টেন্ডার দিয়েই কেনা হচ্ছে। তিনি জানান, এরই মধ্যে সিএমএসডি যথাযথভাবে পিপিআর অনুসরণ করে কেনাকাটার মাধ্যমে ১২৪ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে।

সব হাসপাতালে জরুরি হটলাইন, পরামর্শ ও অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন এবং তা সংশ্নিষ্ট হাসপাতালের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় স্বাস্থ্যমেলা আয়োজন করা হবে। ওই মেলায় কোথায় কী ধরনের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, তা জনগণকে জানানো হবে। সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে ওই সভায়। সামগ্রিকভাবে চিকিৎসকরা যাতে সেবামূলক মানসিকতায় থাকেন এবং অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে উদ্যোগী হন, সে জন্য তিন মাস অন্তর নৈতিকতাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের সুপারিশগুলো স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। দুদক অনেকগুলো ক্ষেত্রে নীতিমালা করার সুপারিশ করেছে। দেশে স্বাস্থ্যসেবায় আইন বা নীতিমালা নেই। এটা থাকা প্রয়োজন। টিআইবিও এ প্রস্তাব করেছিল। আইন থাকলে একটি কাঠামো অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা করা যায়। এখন তো কোনো সমন্বয় নেই। ফলে ব্যাপকভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। তিনি বলেন, তবে শুধু নীতিমালা বা আইন করে এ দুর্নীতি বন্ধ হবে না, তার বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ, দেশে অন্য অনেক ভালো আইন আছে। কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ ঠিকমতো না হওয়ায় তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের ওপর প্রয়োগের দায়িত্ব, তারাই এর সুযোগ নেয়।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, দুই মাস আগে দেশে ক্লিনিকগুলোতে অভিযান হলো। পরে বলা হলো, লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে। সবাই আবেদন করেছে; কিন্তু লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্বে থাকা সংস্থার ক্লিনিক পরিদর্শনসহ অন্যান্য কাজ করার সক্ষমতা বা প্রয়োজনীয় জনবল নেই। এখন দুর্নীতি বন্ধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও একই কথা বলব- শুধু আদেশ জারি করলেই সব ঠিক হবে না। এ জন্য নতুন জনবল, প্রযুক্তি, অর্থায়ন লাগবে। সবচেয়ে বেশি দরকার উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের তদারকি। তা না হলে লাভ কিছুই হবে না।