বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইল-৬ আসনে আওয়ামী লীগে প্রার্থীর ছড়াছড়ি, পিছিয়ে নেই বিএনপি

কাজী মোস্তফা রুমি, বার্তা সম্পাদক : আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা কোমর বেধে মাঠে নেমেছেন। যদিও বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মোতাবেক বর্তমান সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে একপ্রকার সিদ্ধান্তহীনতায় থাকার পরও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রার্থী কাজ করে যাচ্ছেন।

সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে দুই উপজেলার দর্শনীয় স্থান। আওয়ামী লীগ এ আসনটি ধরে রাখতে সচেষ্ট আর বিএনপি আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায়।

টাঙ্গাইল-৬ আসনটি অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত শুধুমাত্র নাগরপুর উপজেলা নিয়েই ছিল। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদের সময় তত্ত্ববধায়ক সরকার নির্বাচনী আসন পুনর্বিন্যাস করে দেলদুয়ার উপজেলাকে টাঙ্গাইল-৬ আসনের সাথে যুক্ত করে। দেলদুয়ার উপজেলাকে পুণর্বিন্যাস করে নাগরপুরের সাথে সংযুক্ত করায় দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাবনা দেখা দিলেও দলীয় কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজয় বরণ করতে হয় বিদ্রোহী প্রার্থীর নিকট।

তবে এই আসনটিতে বিগত সময়ে বিভিন্ন নির্বাচনে প্রায়ই বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছেন ।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার শওকত আলী খান জয়লাভ করেন। এরপর এ আসন থেকে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রার্থী নূর মোহাম্মদ খান আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেতাব আলী খানকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। ১৯৮১ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে নূর মোহাম্মদ খান বিএনপি ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন।

১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির নূর মোহাম্মদ খান আওয়ামী লীগের এআর খানকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে কোন বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করে। ওই নির্বাচনে নূর মোহাম্মদ খান বিজয়ী হন।

১৯৯১ সালে এই আসন থেকে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জননেতা আব্দুল মান্নান নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ‍্যের বিষয় তিনি এখানকার স্থানীয় না হওয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়া সত্বেও জয়লাভ করতে পারেন নি। বিএনপির প্রার্থী আবু তাহের জয় লাভ করেন।

এরপর ১৯৯৬ সালে নৌকা প্রতীকে বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতা খন্দকার আব্দুল বাতেন প্রার্থী হলে সেই সময় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বর্তমান সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটুর ছোট ভাই মরহুম মাসুদুর রহমান মাসুদ ফুটবল মার্কায় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।

পরবর্তীতে দ্বিতীয়বারের মতো ২০০১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আব্দুল বাতেন নৌকা মার্কার প্রার্থী হলে বর্তমান সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটুর মামা তৎকালীন নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সভাপতি মরহুম গোলাম মোহাম্মদ খান তারেক দেওয়াল ঘড়ি মার্কায় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। এতে আবারো হেরে যায় নৌকার প্রার্থী এবং এর মাধ্যমে এই আসন থেকে একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে মনোনয়ন বঞ্চিত আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা। ।

এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আব্দুল বাতেন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে হরিণ মার্কায় নির্বাচন করেন।

ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এ‍্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তীর ইমেজ শূন‍্যতা ও পাশাপাশি বর্তমান সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু স্থানীয় না হওয়ায় তিনি আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট মনোনীত প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও বিপুল ভোটে বিদ্রোহী প্রার্থীর নিকট হেরে যান।

সর্বশেষ ২০১৪ সালে কৃষক লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক কাজী এ.টি.এম আনিসুর রহমান বুলবুল নৌকা মার্কার প্রার্থী খন্দকার আব্দুল বাতেন এর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হতে আনারস মার্কায় নির্বাচন করেন।

এভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে ধারাবাহিকভাবে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে নৌকা মার্কার মনোনীত প্রার্থী হেরে যান।

১৯৭৩ সালের পর এ আসনে নৌকার প্রার্থীরা বারবার পরাজিত হয়েছেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনেই বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমপি হয়েছেন। বিগত নির্বাচনগুলোতে বিএনপি প্রার্থী পাঁচবার, আওয়ামী লীগ প্রার্থী দুইবার, জাতীয় পার্টির প্রার্থী তিনবার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী একবার নির্বাচিত হন।

ইতিমধ্যেই স্থানীয় সাংসদ আহসানুল ইসলাম টিটু এবং নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের দূরত্ব অনেকটাই প্রকাশ্যে। তাই এখানকার স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের ধারণা সুষ্ঠু ও নিরাপেক্ষ নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন না হলে আসনটি হাত ছাড়া হবে আওয়ামী লীগের।

বর্তমানে সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটুর পাশাপাশি মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতা, বর্তমান সময়ে নাগরপুরের স্থানীয় সাহসী সন্তান ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী জননেতা তারেক শামস্ খান হিমু। তিনি দীর্ঘ ২৬ বছর যাবত নাগরপুরের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। নাগরপুরের সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের প্রাণের দাবি এলাসিন সেতু বাস্তবায়নে একমাত্র তিনিই জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এলাসিন সেতু নিয়ে বিএনপির মিথ্যাচারকে ধূলিস্যাৎ করে সেতুটি বাস্তবায়িত হয়। যা এলাকার সাধারণ মানুষ অকপটে স্বীকার করছেন জননেতা তারেক শামস্ খান হিমুর আন্দোলনের ফসল এই সেতু।

তিনি ধারাবাহিকভাবে নাগরপুর দেলদুয়ারে বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে দুইটি উপজেলা আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রেখে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।

এছাড়া পাশাপাশি মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছেন নাগরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সংগ্রামী সভাপতি আলহাজ্ব জাকিরুল ইসলাম উইলিয়াম। তিনি নাগরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নিরলসভাবে দলকে সুসংগঠিত করে টাঙ্গাইল-৬ নাগরপুর দেলদুয়ার আসনে আওয়ামীলীগকে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে কাজ করে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।

এদিকে মনোনয়নের আকাঙ্খায় রয়েছেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সদস্য এ‍্যাড. তারানা হালিম।

যদিও মন্ত্রিপরিষদ সদস্য থেকে সরে যাওয়ার পর এলাকার স্থানীয় ও তৃণমূল নেতৃবৃন্দদের সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ ছিল না। তবে বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগকে পাশ কাটিয়ে নাগরপুর দেলদুয়ারে বিচ্ছিন্নভাবে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন।

এছাড়া তৎকালীন ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক ও বিগত ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ তথা নৌকা র প্রর্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হতে আনারস প্রতীকে নির্বাচন করা কাজী এটিএম আনিসুর রহমান বুলবুল, সাবেক ফুটবলার ও আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ্ব খুরশিদ আলম বাবুল, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুর রহিম ইলিয়াস, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ইনসাফ আলী ওসমানী, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ডা. আব্দুস সালাম প্রামানিক, ব্যবসায়ী সৈয়দ মাহমুদুল ইলা লিলু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট লিমিটেড এর পরিচালক ব্যারিস্টার রেজা ই রাকিব ও আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে বিচ্ছিন্নভাবে মাঠে রয়েছেন।

সম্ভাব্য এসব প্রার্থীরা প্রায় সবাই এলাকার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহায়তা ও জনকল্যাণমূলক কাজে শরিক হচ্ছেন।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় নির্দশনা না থাকা সত্ত্বেও হারানো আসন পুনরুদ্ধারে আগে থেকেই মাঠে কাজ করে যাচ্ছে বিএনপি।

এ‍্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তী টানা দুইবার এ আসন থেকে বিজয়ী হন। ২০০১ সালে বিজয়ী হয়ে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি গত ২০২২ সালের ২৭ শে মে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন।

কেন্দ্রীয় নির্দেশনা না থাকা সত্ত্বেও বিএনপি আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ গোছানোতে ব্যস্ত রয়েছেন নাগরপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ন আহবায়ক ও বর্তমান কমিটির অন্যতম সদস্য, ওয়ার্কার্স রিসেস সেন্টারের(WRC) সম্মানিত চেয়ারম্যান এবং স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের(SBGSKF) সাধারণ সম্পাদক মীর আবুল কালাম আজাদ রতন। যদিও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা নেই, তবুও দলকে সুসংগঠিত করার জন্য এবং নির্বাচনের মাঠে নেতাকর্মীকে সক্রিয় রাখতে তিনি নীরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মোতাবেক যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে এলাকার নেতৃবৃন্দের সাথে অব্যাহতভাবে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছেন।

আগামী নির্বাচনে সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তীর সহধর্মিনী দিপালী রানী চক্রবর্তীর বিষয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। যদিও নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হননি।

নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি হতে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন বিভিন্ন সময়ে দল পরিবর্তনকারী সাবেক মন্ত্রী নূর মোহাম্মদ খান। ইতোমধ্যে তিনি এলাকায় গণসংযোগ করছেন।

এছাড়াও বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি রবিউল আওয়াল লাভলু, কেন্দ্রীয় জাসাসের নেতা ও জেলা বিএনপির নির্বাহী সদস্য শরিফুল ইসলাম স্বপন, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আলী ইমাম তপন, উপজেলা বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন খান।

এছাড়াও নাগরপুর উপজেলা বিএনপির নব গঠিত কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ সালাম এর নামও শোনা যাচ্ছে।

বিএনপির মধ্যেও রয়েছে দলীয় কোন্দল। কোন্দল নিরসন করতে না পারলে নির্বাচনে আসলেও আসনটি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিএনপি ঘরাণার রাজনৈতিক মহল।

এছাড়া জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য মামুনুর রহিম সুমন সম্ভাব্য প্রার্থী এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ হতে দিলীপ ধর সেন্টু সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে তৎপরতা চালাচ্ছেন।